চট্টগ্রাম ধর্ম

মাহে রবিউল আউয়াল মাসের গুরুত্ব ও দয়াল নবীর ধরাধামে শুভাগমন

এস.এম.মাঈন উদ্দীন রুবেল

 

মাহে রবিউল আউয়াল হিজরী বর্ষের তৃতীয় মাস কিন্তু গুরুত্ব এবং মর্যাদার দিক থেকে এই মাস ঈমানদার মুসলমান ও আশেকে রাসূলগনের অন্তরে এক মহাসম্মানিত আসন অধিকার করে আছে। মাহে রবিউল আউয়াল মাসের গুরুত্ব ও মহত্ত্ব অপরিসীম। ছরকারে দু আলম দু জাহানের বাদশাহ সাইয়্যেদুল মুরসালিন খাতেমুন নবীয়্যিন শফিউল মুজনেবীন রাহমাতুল্লিল আলামিন হাবীবে খোদা হযরত মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর শুভ আগমন এই মাসে। যিনি বিশ্বনবী, শেষ নবী, যার শুভাগমনে ধন্য সমগ্র জগৎ, আলোকিত মক্কার মরুপ্রান্তর, যার কারণে চিরভাস্বর মদিনাতুল মুনাওয়ারাহ। স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যাকে উদ্দেশ্য করে ইরশাদ করেছেন, হে রসূল (সাঃ)সমগ্র জগৎবাসীর জন্য আপনাকে রহমত হেসেবেই প্রেরণ করেছি। ওই আয়াত প্রমাণ করছে রসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গোটা সৃষ্টি জগতের জন্য রহমত। আরও ইঙ্গিত বহন করছে আল্লাহ যতটুকুর রব এবং তার প্রিয়বন্ধু হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন ততটুকুর জন্য রহমত। আল্লাহর রুবুবিয়্যাত তথা মালিকানা যে পর্যন্ত বিস্তৃত, ত্রিভূবেনর বাদশা নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নবুয়ত সে পর্যন্ত ব্যাপৃত।
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন যে বরকতপূর্ণ ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত রবিউল আউয়ালে সংঘটিত সঙ্গত সে কারণেই সে মাসটি উম্মতে মোহাম্মদী তথা জগতবাসীর কাছে সম্মানিত, তাৎপর্যমন্ডিত ও মহিমান্বিত।

এই মাসের শুভাগমনে বিশ্বের ঈমানদার মুসলমানদের অন্তরে প্রবাহিত হতে থাকে এক মহব্বতের ফল্গুধারা। সবাই অনুভব করে আনন্দ ও এক অনাবিল প্রশান্তি।
এই সেই রবিউল আউয়াল মাস, যেই মাসে তশরীফ এনেছেন আল্লাহ তবারকা ওয়া তাআলার প্রিয় বন্ধু, প্রিয় হাবীব, আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টি জগতের জন্য রহমত বরকত ও মানব জাতির কল্যাণকামী এবং উম্মতের মুক্তিদাতা আখেরী নবী হুজুর পুরনূর (সাঃ), আকায়ে নামদার, শফিউল মুজনেবিন, রহমতুিল্লল আলামিন, হযরত আহমদে মোজতবা মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। ১২ই রবিউল আউয়াল রোজ সোমবার ছোবহে ছাদেকের সময় পবিত্র মক্কা মোয়াজ্জামায় হযরত মা আমেনার (রাঃ) পবিত্র শেকমে পাক থেকে দুনিয়ার বুকে তশরীফ আনলেন হুজুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু তাআলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হাদীছে পাক এবং অন্যান্য কেতাবের রেওয়ায়েত মতে কোন রকম অপবিত্রতা ব্যতিরেকে সম্পূর্ণ পাক পবিত্র অবস্থায় বেহেশতি পোশাক পরিহিত, চোখে সুরমা দেওয়া আল্লাহর পেয়ারা হাবীব (সাঃ) তশরীফ আনলেন। দুনিয়ার জমিনে তশরীফ এনেই তিনি আল্লাহর দরবারে সেজদায় পড়লেন এবং শাহাদাত অঙ্গুলী উপরে তুলে আল্লাহর একাত্মতা এবং স্বীয় নবুওতের ঘোষণা দিলেন এবং উম্মতের জন্য দোয়া করলেন “রাব্বি হাবলী উম্মতি, রাব্বি হাবলী উম্মতি”।
বিভিন্ন রেওয়ায়েত মতে, হযরত মা আমেনা (রাঃ) বর্ণনা করেন, “আমার শিশু সন্তান যখন ভূমিষ্ঠ হচ্ছিল তখন আমি শুনতে পাচ্ছিলাম অনেক লোকের আওয়াজ। তারা সালাম দিতে দিতে আমার ঘরের দিকে আসছিল।” রেওয়াতে রয়েছে আল্লাহ তবারকা ওয়া তাআলার নির্দেশে হযরত জিবরাঈল (আঃ) এর নেতৃত্বে ঝাণ্ডা নিয়ে মিছিল বা জুুলুস সহকারে হাজার হাজার ফেরেস্তা আখেরী নবী ইমামুল আম্বিয়া নবী করীম (সাঃ) কে মোবারকবাদ ও সালাম আরজ করতে করতে হযরত মা আমেনার (রাঃ) গৃহের দিকে আসছিলেন এবং এই ঝান্ডা পবিত্র কাবা শরীফের উপরে স্থাপন করেন। এই বিষয়টিই চতুর্দশ শতাব্দীর মোজাদ্দেদ আ’লা হযরত আহমদ রেজা খাঁন ফাজেলে বেরলভী (রহঃ) তাঁর কিতাবে উল্লেখ করেছেন- “ফেরেশতোঁ ­­­কী সালামী দেনে ওয়ালী ফৌজ গাতি থী, হযরতে মা আমেনা ছুনতি থী আওয়াজ আতি থী”। আল্লাহর পেয়ারা হাবীব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সাঃ) এর ধরাধামে শুভাগমনে পবিত্র দিনটিকে উপলক্ষ করে সারা দুনিয়ার ধর্মপ্রাণ নবী প্রেমিক মুসলমানগণ উদযাপন করেন পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তাআলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম। পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) এর সাধারণত অর্থ ‘ঈদ’ অর্থ আনন্দ আর ‘মিলাদুন্নবী (সাঃ) এর অর্থ হলো পবিত্র জন্মদিন বা খোশরোজ। মিলাদুন্নবী আরবী শব্দ। আভিধানিক অর্থ হচ্ছে নবী (সাঃ) এর শুভাগমন। সুতরাং ‘ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) এর সার্বিক অর্থ দাঁড়ায় নবী করীম (সাঃ) এর শুভাগমন উপলক্ষে আনন্দ বা খুশী উদযাপন করা। এখানে একটি প্রশ্ন থাকতে পারে আমাদের আরো দুটি ঈদ রয়েছে। একটি পবিত্র ঈদ-উল ফিতরের দিন অর্থাৎ শাওয়াল মাসের প্রথম দিন এবং আরেকটি জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখ ঈদুল আজহা বা পবিত্র কোরবানির ঈদ। এই দুইটা ঈদ আমরা প্রতি বছর উদযাপন করে থাকি। এই দুটি ঈদ দুনিয়ার ধর্মপ্রাণ মুসলমান অতি মর্যাদা সহকারে পালন করে থাকেন। আর পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) এমন একটি অনুষ্ঠানের নাম, একটি দিবসের নাম, একটি কর্মকাণ্ডের নাম যার সাথে জড়িয়ে আছে কুল কায়েনাতের বিশ্বাস, অবস্থান এবং বর্তমান ভবিষ্যৎ। ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) আল্লাহ তবারকা ওয়া তাআলার পক্ষ থেকে এমন এক নেয়ামত যা গ্রহণ, পালন এবং যার শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে থাকেন। পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) কেন এত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা হাদীসে কুদসীতে নবী করিম (সাঃ) কে উদ্দেশ্য করে এরশাদ করেন- “লাওলাকা লামা খালাকতুল আফলাক।” অর্থাৎ ‘‘(হে নবী), আমি যদি আপনাকে সৃষ্টি না করতাম তাহলে আমি কিছুই সৃষ্টি করতাম না।” এই হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তবারক ওয়াতাআলা পরিষ্কার করে স্বীয় রসুল (সাঃ) এর সৃষ্টির উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন। এই বিশ্ব জগৎ, আসমান-জমিন, বেহেশত-দোজখ, আরশ-কুরসী সব কিছু সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর প্রিয় হাবীব (সাঃ) কে আঠার হাজার মাখলুকাতের সামনে প্রকাশ করা। শুধু প্রকাশ করা নয় আল্লাহর রহমত স্বরূপ মানবজাতির কল্যাণে দুনিয়ার জমিনে প্রেরণ করা। যেমন, আল্লাহ তাআলা কোরআনে করিমে এরশাদ করেন, “ওয়ামা আরছালনাকা ইল্লা রহমতুল্লিল আলামিন”। অর্থাৎ (হে নবী), আমি আপনাকে সমস্ত সৃষ্টির জন্য শুধুমাত্র রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।” এই জন্যে বলা হয়, সকল ঈদের সেরা ঈদ- ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ)।
আল্লাহ তবারকা ওয়া তাআলা মানব জাতির জন্য অফুরন্ত রহমত ও নি’মাতের ভাণ্ডার খুলে দিয়েছেন। সুরা আর রাহমানে আল্লাহ তবারকা ওয়া তাআলা এমন অনেক নেয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন এবং সে সব নেয়ামতের কথা বান্দাগণ যাতে অস্বীকার না করে তার জন্য সতর্ক করে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা আরেক আয়াতে নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার জন্য মানব জাতিকে নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, “ফায্কুরূনী আযকুরকুম, ওয়াশকুরূলী ওলা তাকফুরুন”। অর্থাৎ, “যদি তোমরা আমাকে স্মরণ কর আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব এবং আমার শোকরগোজারী কর এবং না শুকরী করোনা”। বুঝা গেল যে, আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের বা রহমতের শুকর গুজার হওয়া আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং অবশ্যই কর্তব্য। আরেক আয়াতে করিমায় আল্লাহ তবারক তাআলা স্বীয় হাবীব (সাঃ) কে উদ্দেশ করে বলেন, “কুুল ইয়া এবাদিয়াল্লাজিনা আছরাফু আলা আনফুছেহিম, লা তাকনাতু মির রাহমাতিল্লাহ্। ইন্নাল্লাহা ইয়াগ ফেরুজ জুনুবা জামিয়া, ইন্নাহু হুয়াল গাফুরুর রাহীম”। এই আয়াতে আল্লাহ তবারকা ওয়া তাআলা স্বীয় হাবীব (সাঃ) এর মাধ্যমে তার গোনাহগার বান্দাদেরকে গোনাহের কারণে তাঁর রহমত থেকে নিরাশ না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এবং বলেছেন তাদের সব গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দিবেন। যে রহমতের কথা আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন সে রহমত তো উপরে উল্লেখিত অপর এক আয়াতে করিমা মতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বয়ং। অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা তার গুনাহগার বান্দাদেরকে নবী করিম (সাঃ)- নেগাহে করম লাভ করা থেকে নিরাশ বা হতাশ না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।তিনি আঠারো হাজার মখলুকাতের জন্য নেয়ামত ও রহমত স্বরূপ। কারণ হাদীসে কুদসী মতে রাসূলে করিম (সাঃ) কে সৃষ্টি না করলে আল্লাহ কোন কিছুই সৃষ্টি করতেন না। বাকী সব নেয়ামত আমরা পাই রাসূলে করিম (সাঃ) এর মাধ্যমে। এক হাদীছে পাকে রাসূলে করিম (সাঃ) এরশাদ করেন, “আনা কাছেমুন ওয়াল্লাহ ইয়ুতি”। অর্থাৎ, “আল্লাহ দান করেন আর আমি বন্টনকারী”। সুতরাং, নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা সকল মানব জাতির জন্য বিশেষ করে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চাই। শুকরিয়া আদায় করার একটি উল্লেখযোগ্য মাধ্যম হলো বেশী পরিমাণে নবী করিম (সাঃ) এর উপর দরুদ ও সালাম পাঠ করা যা কোরানে করিমের ঘোষণা মতে আল্লাহ তার সমস্ত ফেরেশতাদের নিয়ে প্রতিনিয়ত বিরতিহীনভাবে দরুদ শরীফ পাঠ করে থাকেন এবং আমাদেরকে ও নবী করিম (সাঃ) -এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
নেয়ামতের শুকরীয়া আদায়ের আরেকটি এবং বড় এবাদত হলো খুশী উদযাপন করা। কোরানে করিমে আল্লাহ তবারকা ওয়া তাআলা এরশাদ করেন, “কুল বেফাদলিল্লাহে ওয়া বেরাহমাতিহি ফাবিজালিকা ফাল ইয়াফরাহু” অর্থাৎ, (হে রাসূল) আপনি বলুন, (সবকিছু) আল্লাহর দয়া ও মেহেরবানীতে। সুতরাং এরই প্রতি তারা (মুসলমানগণ) যেন খুশী উদযাপন করে। তারা যা সঞ্চয় করছে তা থেকে এটিই শ্রেষ্ঠতর”। এই আয়াতে করিমার তফসির করতে গিয়ে বিশ্ববিখ্যাত তাফসির বিশারদগণ যেমন, আল্লামা মাহমুদ আলুসী, আল্লামা ইমাম জালালুদ্দিন ছুয়ুতি, ইমাম আবু হাইয়ান আনদালুসী রাহমাতুল্লাহি আলাইহিম বলেন, “তোমাদের প্রতি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রেরণ করে এবং কোরআন অবতীর্ণ করে আল্লাহ তোমাদের উপর যে দয়া ও করুণা করেছেন তাতে তোমরা খুশী উদযাপন কর।

রবিউল আওয়াল মাসের চাঁদ আকাশে উঁকি দিতেই বিশ্বের মুসলমানদের মাঝে নতুন করে এক আন্দোলন শুরু হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মহাব্বত নতুন করে জাগ্রত হয়। কারণ, অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতানুসারে এ মাসে সায়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন খাতেমুন নাবীয়্যিন এ ধরাপৃষ্ঠে শুভাগমন করেন, পবিত্র মক্কা থেকে মদিনা মুনাওয়ারা হিজরত করেন এ মাসে, আবার এ মাসেই তিনি আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত রিসালাতের সকল দায়িত্ব পালন শেষে স্বীয় প্রভুর আহবানে সাড়া দিয়ে পরলোক গমন করেন।

যখনই এ মাসের শুভগমন হয়, মুসলমানদের অন্তরে, আশেকে রাসূলগনের অন্তরে স্বাভাবিকভাবে নবী-প্রেমের নতুন হাওয়া জাগে, তারা নতুন করে আন্দোলিত হয়। আবার রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকাল করেছেন, এ বিষয়ে কোনো মতানৈক্য নেই। আশেকে রাসূলগনের মতে,সুন্নিদের মত নবী করিম (সাঃ) আগমন যেমন উম্মতের জন্য রহমত তেমনিভাবে দুনিয়া ছেড়ে যাওয়া ও রহমত। তাই প্রকৃত নবীপ্রেমিকগন যারা নবীকে জানের চেয়ে পরিবারের চেয়েও বেশি ভালোবাসে তারা সিরাতুন্নবী পালন না করে মিলাদুন্নবী উদযাপন করে।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উদ্দেশে অসংখ্য দরূদ, যার পরে আর কোনো নবী নেই।

রাহমাতুললিল আলামিন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন একটি প্রিয় নাম যা প্রত্যেক মুসলিম তার অন্তরে মহব্বতের সঙ্গে স্মরণ করে থাকে।
মুমিনের দিলে যে কারণে আল্লাহতাআলার মহব্বত গভীর, সে কারণেই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি মহব্বত গভীর হওয়া স্বাভাবিক।

আল্লাহপাক বলেন, ‘যারা ঈমানদার তাদের মহব্বত গভীর হওয়া স্বাভাবিক’ (সূরা বাকারা: ১৬৫)।
আল্লাহপাক আবার বলেন, ‘হে রাসুল! আপনি বলে দিন যে যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবেসে থাক, তা হলে আমার অনুকরণ করো, তা হলে আল্লাহই তোমাদের ভালোবাসবেন। ’

এ দু’টি আয়াত থেকে বোঝা গেল যে মুমিন আল্লাহকেই বেশি ভালোবাসেন এবং এ ভালোবাসা প্রকাশের একমাত্র পথ হলো রাসুলের অনুসরণ, অনুকরণ ও আনুগত্য।

কিন্তু রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসা ছাড়া কি তাঁর আনুগত্য সম্ভব? তাই আল্লাহকে ভালোবাসার স্বাভাবিক পরিণতিই হলো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালোবাসা কি পরিমাণ থাকা উচিত সে কথা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন।

তিনি বলেছেন- ‘তোমাদের কেউ সত্যিকারের মু’মিন হবে না, যে পর্যন্ত আমি তার নিকট তার পিতা, পুত্র ও সকল মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় বলে গণ্য না হবো। ’

আল্লাহপাক পিতা-মাতা, স্ত্রী-পুত্র, ভাই-বোন আত্মীয়স্বজনকে ভালোবাসা কর্তব্য বলে জানিয়েছেন। কিন্তু কারো প্রতি ভালোবাসা যেন রাসূলের চেয়ে বেশি না হয়, বরং সবার চাইতে যেন রাসূলের প্রতি ভালোবাসা অধিকতর গভীর ও তীব্র হয়, সে কথাই এ হাদিসে বলা হয়েছে।

রবিউল আউয়াল
মু’মিনের দিলে রাসূলের প্রতি যে মহব্বতের দরিয়া প্রবাহিত হয় তাতে রবিউল আউয়াল মাসে যেন বান ডাকে। মহব্বতের এ জোয়ার এ মাসে সর্বত্রই টের পাওয়া যায়। এ মাসে যে পরিমান মিলাদুন্নবী (সাঃ) উদযাপিত আর কোন মাসে হয় না। বড় বড় মাহফিলে, মসজিদে, অফিসে, বাড়িতে, সর্বত্র এ মাসে মিলাদুন্নবী (সাঃ) এর ব্যাপক আয়োজন হয় এবং তাতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন থেকে শিক্ষণীয় বিষয় সম্পর্কে ইসলামী চিন্তাবিদ ও ওলামায়ে কেরাম মূল্যবান আলোচনা পেশ করেন।

এসব অনুষ্ঠানে সমবেতভাবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি যে পরিমাণ দরুদ ও সালাম পেশ করা হয় বছরের আর কোনো মাসে এতটা হয় না।

এ মাসটি এ ব্যাপারে এমন এক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যার কোনো তুলনা নেই। বিশেষ করে ১২ রবিউল আউয়ালে পাড়া,মহল্লায়, বাড়িতে যেভাবে মিলাদুন্নবী (সাঃ) এর আয়োজন করা হয়, এমনভাবে এক দিনে আর কোনো সময় করতে দেখা যায় না এবং পুরো মাসব্যাপী এই আয়োজন চলতে থাকে।

মহানবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাসা ও তাঁর দেখানো পথ অনুযায়ী জীবন-যাপন করা ঈমানের অংশ। এ প্রসঙ্গে ইমাম বুখারী (রহঃ) তার কিতাবে স্বতন্ত্র একটি শিরোনাম এনেছেন, যার অর্থ ‘নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভালবাসা ঈমানের অঙ্গ’। বিশিষ্ট সাহাবী আনাস (রাঃ) ও আবূহুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত: ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ওই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ আমি তার নিকট নিজ পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সকল মানুষ হতে প্রিয় না হবো’। (বুখারী শরীফ : হা: ১৫, মুসলিম শরিফ: হা: ৪৫, মুসনাদে আহমদ: ১২৪৩)।

কোরআনে কারিমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, হে নবী! আপনি বলুন, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা-মাতা, তোমদের সন্তান, তোমাদের ভাই-বোন, তোমাদের পত্নি, তোমাদের বংশ, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের এমন ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা পছন্দ কর; আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল এবং তাঁর রাহে জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় না হয়, তাহলে অপেক্ষা কর- আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না। (সূরা তাওবা : ২৪)।

উল্লিখিত আয়াতে গোটা মুসলিম জাতির প্রতি এ আদেশ দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালবাসা এমন উন্নত স্তরে রাখা ওয়াজিব, যে স্তরে অন্য কারো ভালবাসা স্থান পাবে না। তাই যার ভালবাসা এ স্তরে নেই সে শাস্তির যোগ্য।

তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভালবাসার অর্থ হলো, তিনি যে সকল গুণে গুণান্বিত ছিলেন সেগুলোর চর্চা করা ও নিজের মাঝে সেগুলোর বাস্তবায়ন এবং যে সকল বিষয় তিনি পরিহার করেছেন ও পরিহার করতে বলেছেন তা পরিহার করা। এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আনীত দ্বীনকে তোমরা আকড়ে ধর, আর যা নিষেধ করেছেন তা পরিহার কর’। (আল হাশর : ৭)।

কোরআন ও হাদিসে প্রত্যেকটি বিষয় যেভাবে এসেছে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামগণ যেভাবে আমল করেছেন বা করতে বলেছেন সেভাবে করা বা মেনে নেয়ার নামই হলো ইবাদত। এতে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি করাকে শরিয়ত সমর্থন করে না। এমনিভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভালবাসার ব্যাপারে তিনি যেভাবে ভালবাসতে বলেছেন বা সাহাবায়ে কেরামগণ যেভাবে ভালবাসা দেখিয়েছেন সেভাবে ভালবাসাই হলো ইবাদত। এতে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি করা শরিয়ত সমর্থন করে না। পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপার নিষেধও করেছেন। তিনি বলেছেন, খ্রীষ্টানরা যেমনভাবে ঈসা ইবনে মারিয়ামের (আঃ) ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে, তোমরা তেমনিভাবে আমার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর বান্দা, অতএব, তোমরা বল আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল।

তাই প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর আদর্শক বুকে ধারণ করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে হালাল রুজি-রোজগার করে সৎভাবে জীবন যাপন করে তার দেখানো পথে মতে চলে আল্লাহ ও তার হাবীব (সাঃ) এর সন্তুষ্টি অর্জন করাই ঈমানদার মুসলমানদের কাজ।
আমার এ প্রয়াস যেন আল্লাহ পাকের পরে প্রিয় নবীর প্রতি প্রেম মুহব্বত সর্বোচ্চ হয় এবং তার সাথে যাতে দুনিয়ায় আর করো তুলনা না হয়।

লেখক ও কবি এস.এম.মাঈন উদ্দীন রুবেল

Related Posts