নিজস্ব প্রতিবেদক
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) শোয়া এক তরুণের মাথা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। পুরো মাথায় ব্যান্ডেজ। ধবধবে সাদা ব্যান্ডেজের ওপর লেখা, ‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না।’ নিচে একটা বিপজ্জনক চিহ্নও এঁকে দেওয়া হয়েছে। চোখও সাদা ব্যান্ডেজে ঢেকে দেওয়া হয়েছে তাঁর। তিনি এখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
সংজ্ঞাহীন এই তরুণের নাম মাহাদি জে আকিব। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তিনি। গত শনিবার সকালে কলেজের কিছু ছাত্র তাঁর ওপর হামলা করে। মাথায় মারাত্মক জখম নিয়ে ভর্তি হন চমেক হাসপাতালে। আঘাত গুরুতর। অস্ত্রোপচারের পর তাঁর ঠাঁই হয় আইসিইউতে। এর পর থেকে নিথর পড়ে আছেন আকিব। তাঁর মাথায় এমন লেখার রহস্য জানা গেল চিকিৎসকদের কাছে।
অস্ত্রোপচারের দায়িত্বে থাকা সহকারী অধ্যাপক মাহফুজুল কাদের বলেন, আঘাত খুব বেশি ছিল। তার মস্তিষ্কে এবং মাথার হাড়ে মারাত্মক আঘাত রয়েছে। মাথার হাড়ের একটা অংশ খুলে আপাতত তার পেটের চামড়ার নিচে রাখা হয়েছে। কিছুটা উন্নতি হলে সেটা আবার আগের জায়গায় প্রতিস্থাপন করা হবে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই পদ্ধতিটির নাম, ‘De compressive craniectomy with evacuation of epidural and subdural hematoma.’
গত শনিবার সকাল ৯টায় চমেকের মেইন গেটের অদূরে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সামনে অতর্কিত হামলা করে ছাত্রলীগের একটি পক্ষ। তাঁকে কীভাবে মারা হয়েছে তাঁর বর্ণনা দিলেন চমেকের শেষ বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা মো. ইমন সিকদার।
তিনি বলেন, গতকাল সকাল ৯টায় সিনিয়ররা তখন চমেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। নিচে ছিলেন মাহাদি আকিবসহ জুনিয়ররা। হঠাৎ ধাওয়া দিয়ে চমেকের মেইন গেটের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের। পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সামনে মাহাদি আকিবকে পেয়ে ঘিরে ধরেন প্রতিপক্ষরা। গলায় রিকশার চেইন দিয়ে বাধা হয়। কাচের বোতল দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়। রামদা দিয়ে কোপানো হয় মাথায়। পরে হকিস্টিক দিয়ে মাথা থেঁতলে দেওয়া হয়েছে। এ সময় তাঁকে উদ্ধার করে চমেকে নিয়ে যাওয়া হয়।
মাথায় ব্যান্ডেজের ছবিটি ঘুরছে আকিবের বন্ধু-স্বজনদের ফেসবুকে। এর পাশাপাশি খোলা আকাশের নিচে হ্রদে তোলা আকিবের সুন্দর একটা ছবিও ঘুরছে বন্ধুদের ওয়ালে। অভিজিৎ দাশ নামে এক ছাত্র লিখেছেন, ‘আকিব আবার ফিরে আসবে আমাদের মাঝে পরম করুণাময়ের কৃপায়। ওপরে একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। তিনি সহায়।’
আকিবের বাড়ি কুমিল্লার বুড়িচং থানায়। ছেলের এমন দুঃসংবাদ পেয়ে ছুটে এসেছেন বাবা মিজানুর রহমান ও ভাই তৌফিকুর রহমান। আইসিইউ এর সামনে স্বজন-বন্ধুরা অপেক্ষা করছেন, আকিব সুস্থ হয়ে ফিরবেন এই বিশ্বাস তাদের। তাঁর বাবা ও ভাই কেবল সবাইকে আকিবের জন্য দোয়া করতে বলেছেন। তবে চিকিৎসকেরা এখনো তাঁকে শঙ্কাহীন বলছেন না।
এ বিষয়ে চমেকের অধ্যাপক ও ক্লিনিক্যাল নিউরো সার্জন এবং নিউরো সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এসএম নোমান খালেদ চৌধুরী বলেন, মাহাদি আকিবকে যখন আমরা পাই তখন তাঁর মাথা থেঁতলানো ছিল। হাড় ভেঙে গেছে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। ব্রেইন ডেমেজও হয়েছে। এই অবস্থায় অপারেশন করে মাথার কিছু অংশ তাঁর শরীরের মধ্যে সংরক্ষণ করে রাখি।
শনিবার রাতেই তৌফিকুর রহমান বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় একটি মামলা করেছেন। পুলিশ আকিবের ওপর হামলাকারী দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। আকিবের ওপর হামলা হয় কলেজের সামনের সড়কের ফুটপাতের ওপর। পপুলার ডায়াগনস্টিকের সামনের ফুটপাতে। সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, সাত আটজন তাঁকে ঘিরে ধরে মারছে। মাথায় আঘাত করছে।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রধান ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগের দুটি পক্ষের মধ্যে মারামারি হয়। এই ঘটনার জের ধরে শনিবার আকিবের ওপর হামলা হয়। চমেক ছাত্রলীগে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এবং সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের দুটি পক্ষ সক্রিয় রয়েছে।