প্রভাষ আমিন:
ঘুরতে আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতায় খুব বেশি ঘোরাঘুরির সুযোগ হয়নি। বিশ্বের অল্প যে কটি শহর আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, তাতে পছন্দের তালিকায় এক নাম্বার নাম ওয়াশিংটন ডিসি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী। বছর দশেক আগে একবার স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছিলাম। ২১ দিনের সেই ব্যস্ত সফরে অনেকের সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে; অনেক শহর ঘুরেছি। তবে ওয়াশিংটন ডিসির স্নিগ্ধতা আর আভিজাত্য আমায় মুগ্ধ করেছে। ক্যাপিটল হিলে অবস্থিত ইউএস ক্যাপিটল ভবন তাদের আভিজাত্যের প্রতীক, গর্বের প্রতীক। ওয়াশিংটনে ক্যাপিটল ভবনের চেয়ে উঁচু কোনো ভবন নেই। সেই গর্ব আর আভিজাত্যকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে আমরিকারই কিছু উন্মত্ত ট্রাম্প সমর্থক।
৬ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উস্কানিতে তার কয়েক হাজার সমর্থক ক্যাপিটল ভবনে হামলা চালায়। গত বছরের ৪ নভেম্বর শেষ হওয়া নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটেছে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের। ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন পেয়েছেন ৩০৬টি ইলেকটোরাল ভোট, যেখানে ২৭০টি ভোটই হোয়াইট হাউজে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। শুধু ইলেকটোরাল ভোট নয়, পপুলার ভোটেও এগিয়ে বাইডেন, ট্রাম্পের চেয়ে ৭০ লাখ ভোট বেশি পেয়েছেন তিনি। নির্বাচনের আগে থেকেই ট্রাম্প বলে আসছিলেন, না জিতলে তিনি নির্বাচনের ফল মানবেন না।
নির্বাচনের পর তিনি কথা রেখেছেন, ফলাফল মানেননি (পরে অবশ্য মানতে বাধ্য হয়েছেন)। কিন্তু একের পর এক মামলা করেও কাউকে পাশে পাননি। শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প চূড়ান্ত হামলা চালালেন ইউএস ক্যাপিটলে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকভাবে ফলাফল ঘোষণার দিনে ট্রাম্পের লেলিয়ে দেয়া উন্মত্ত সমর্থকরা হামলা চালালো মার্কিন গণতন্ত্রের পিঠস্থানে। ট্রাম্প সমর্থকরা ক্যাপিটল ভবনে রীতিমত তাণ্ডব চালায়। স্পিকারের আসন দখল করে নেয়। এই লেখা পর্যন্ত চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে একজন নারী। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৫২ জনকে। এ ঘটনায় আমার প্রিয় ওয়াশিংটনে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে। বিশ্বের গণতন্ত্রের হেফাজতকারী, মানবাধিকারের প্রবক্তা, সভ্যতার মুরুব্বি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যা দেখিয়েছে তা সত্যিই অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত। নজিরবিহীন বলবো না, কারণ ২০৬ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য যুদ্ধের সময় ক্যাপিটল হিলে হামলা হয়েছিল।
তবে সে হামলা ছিল বহিঃশত্রুর। আর এবারের হামলা মার্কিনীদেরই। এরাও শত্রু। এরা আমেরিকার শত্রু, এরা গণতন্ত্রের শত্রু, এরা সভ্যতার শত্রু। আর এদের পালের গোদা হলো ডোনাল্ড ট্রাম্প, যাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে হোয়াউট হাউজ থেকে বের করে দেয়াটাই শুধু বাকি আছে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রতীক। ২০০১ সালে আত্মঘাতী বিমান হামলায় ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার ধ্বংস করে জঙ্গীরা কার্যত আমেরিকার গর্বের ওপর আঘাত করেছিল। আর ক্যাপিটল ভবন হলো তাদের গণতন্ত্রের প্রতীক। এবারের হামলাটি তাই গণতন্ত্রের ওপর। তবে আমি মনে করি, এই হামলাটি মার্কিনীদের পাওনা ছিল। ২০১৬ সালের নির্বাচনে আমেরিকানরা ভোট দিয়েই ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত এক বদ্ধ উন্মাদ, কট্টর বর্ণবাদী, স্থুলবুদ্ধির ব্যবসায়ীকে প্রেসিডেন্ট বানিয়েছিল। সেই পাপের শাস্তি পাচ্ছে আজ মার্কিনীরা। গত চার বছরে ট্রাম্প বারবার প্রমাণ করেছেন, তিনি কত বড় উন্মাদ আর আমেরিকানরা কত বড় ভুল করেছে। ট্রাম্প কার্যত মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদের মর্যাদাকে ভুলুণ্ঠিত করেছেন। একের পর এক মিথ্যা বলে তিনি আসলে সত্য-মিথ্যার ফারাক ঘুচিয়ে দিয়েছেন। ক্যাপিটলে হামলার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
দীর্ঘ চর্চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, সভ্যতা, মানবাধিকারের একটা মানদণ্ডে পৌঁছানোর দাবি করছিল। যদিও নিজ দেশে যাই হোক; বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র ধ্বংস, মানবাধিকার ধ্বংস, যুদ্ধ বাধানোর মূল কারিগর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অন্তরে যাই থাক, মুখে মার্কিনীদের চেয়ে বড় গণতন্ত্রী, সভ্য আর কেউ নেই। কিন্তু ট্রাম্প এসে মার্কিন সমাজের আসল চেহারাটা উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। মুখোশের আড়ালে মার্কিনীরাও যে কত অসভ্য, চরম বর্ণবাদী, তা দেখিয়ে দিয়েছেন ট্রাম্প। ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিনীদের লুকিয়ে থাকা কট্টর জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়ে ক্ষমতায় গেছেন, সেই অস্ত্রে ক্ষমতায় থাকতেও চেয়েছিলেন। ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ এই স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু তিনি চার বছরে সাফল্যের সঙ্গে ইউনাইটেড স্টেট অব আমেরিকাকে বিভক্ত করতে পেরেছেন।
২০১৬ সালের নির্বাচনের পর অভিযোগ উঠেছিল রাশিয়া ট্রাম্পকে জেতাতে সহায়তা করেছে। এখন তো মনে হচ্ছে, পুতিন পরিকল্পিতভাবে ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট বানিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রকে ধ্বংস করার জন্য। তবে মার্কিন গণতন্ত্রের ভিতটা এত শক্ত, এক ট্রাম্পের পক্ষে তাতে আঘাত করা কঠিনই। তবে গণতন্ত্রের সাজানো পদ্ম বাগান তছনছ করে দেয়ার জন্য ট্রাম্পের মত এক মত্ত হাতিই যথেষ্ট। এমন ঘটনা যে ঘটতে পারে, তার কিছুটা শঙ্কা কিন্তু আগেই ছিল। গত ৩-৪ নভেম্বরের নির্বাচনের আগে আমেরিকার বড় বড় শহরে বড় বড় শপিং মলে আলাদা পাহারা বসানো হয়েছিল লুটের ভয়ে। কারণ এর আগে ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটার্স’ আন্দোলনের সময়ও ব্যাপক লুটপাটের ঘটনা ঘটেছিল।
ক্যাপিটল ভবনে হামলা শুধু মার্কিন গণতন্ত্রের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির জন্যই ক্ষতিকর হবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র গোটা বিশ্বের গণতন্ত্রের রক্ষাকর্তা বলে দাবি করে নিজেদের। তবে ক্যাপিটলে এ হামলার পর আশা করি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সভ্যতা নিয়ে আর কাউকে সবক দেবে না।
নির্বাচনের ফলাফল মেনে না নেয়ার সংস্কৃতি তৃতীয় বিশ্বের, বিশেষ করে বাংলাদেশের। ডোনাল্ড ট্রাম্প তো কখনো বাংলাদেশে আসেননি, তাহলে তিনি এই শিক্ষা পেলেন কোথায়? নভেম্বরে অনুষ্ঠিত মার্কিন নির্বাচনের ফল পেতে এবার চারদিন অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে, আসলে অপেক্ষায় ছিল গোটা বিশ্বই। তার কয়েকদিন পর এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বলেছিলেন ‘যুক্তরাষ্ট্র ৪/৫ দিনেও ভোট গণনা শেষ করতে পারে না। আর আমরা ইভিএমে ৪/৫ মিনিট থেকে ১০ মিনিটে ফল ঘোষণা করে দিতে পারি। এই জিনিস যুক্তরাষ্ট্রে নেই। তাদের প্রায় ২৫০ বছরের গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতায় সেটা এখনও পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের আমাদের থেকে শিক্ষা-দীক্ষা নেওয়া উচিত।’ আমার ধারণা ট্রাম্প হয়তো গোপনে বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা নিয়েছে এবং শিক্ষাটা একটু বেশিই নিয়েছেন। তাই শুধু ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেই বসে থাকেননি ট্রাম্প, ক্যাপিটলে হামলা চালাতে লেলিয়ে দিয়েছেন তার উগ্র সমর্থকদের। তবে সব ঘটনারই ভালো দিকও থাকে। ট্রাম্পের এই পাগলামির পর প্রতিবাদ হচ্ছে সব মহল থেকে, বিশ্বজুড়ে। এমনকি ট্রাম্পের দলের লোকেরাও তার পাশে নেই। ‘ট্রাম্প-ইজম’ বলে যে অশুভ ধারণা তৈরি হচ্ছিল, তার সর্বোচ্চ খারাপটা দেখে ফেলেছে বিশ্ব। এখন সময় প্রতিরোধের, চাই অশুভের বিরুদ্ধে শুভের লড়াই।
আশা করি ক্যাপিটল ভবনে হামলার মাধ্যমেই চিরতরে কবর হবে ট্রাম্প-ইজমের। সুখের কথা হলো, ট্রাম্পরা সংখ্যায় কম। বিশ্বে ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি। আর শুভ শক্তির জয় অবশ্যম্ভাবী। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি নির্দিষ্ট ঘটনা নিয়ে লেখা। এর সাথে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির কোনো সম্পর্ক নেই। তাই বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে না লিখে কেন আমেরিকার গণতন্ত্র নিয়ে লিখছি, সে প্রশ্ন কেউ তুলবেন না। বাংলাদেশে যে গণতান্ত্রিক স্পেস সীমিত, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত, নির্বাচনী ব্যবস্থা যে দুমড়ে মুচড়ে গেছে, ২০১৮ সালের নির্বাচনটি যে বিশ্বাসযোগ্য নয়—এসব কথাই আমরা জানি এবং আমি অনেকবার লিখেছিও। তাই এই লেখার সাথে কেউ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি মেলাবেন না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট