সিনিউজ ডেস্ক:
বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে হঠাৎ ডোপ টেষ্ট বেশ আলোচিত ও সমালোচিত। স¤প্রতি ডোপ টেষ্টে ঢাকা পল্লবী থানার এক উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) আরিফ হোসেন মল্লিকের শরীরে মাদকের উপস্থিতি পাওয়ায় তিনি চাকুরী থেকে বরখাস্ত হয়েছেন।
জানুয়ারি মাসে এমন একটি রিপোর্ট দিয়েছেন রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা। এসআই আরিফের শরীরে হেরোইন এর আলামত রয়েছে বলে এমন পজেটিভ রিপোর্ট প্রদান করা হলে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত তাঁকে জানা শোনা বহু পুলিশের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে নানা কানাঘোষা। সেই সাথে প্রশ্ন ওঠেছে ডোপ টেষ্টের ফলাফল নিয়েও।
জানা যায়, বর্তমানে ডিএমপি পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম এর নির্দেশে পুলিশ বাহিনীর মধ্যে (কনস্টেবল থেকে এসআই পর্যন্ত) যাঁদের বিরুদ্ধে মাদকের সাথে জড়িত বলে অভিযোগ আছে তাদের সবাইকে ডোপ টেষ্ট করানো হচ্ছে। যাঁদের বিরুদ্ধে প্রমাণ মিলবে তাঁদের চাকুরী থেকে বরখাস্ত করা হচ্ছে। ধারাবাহিকতায় ডোপ টেষ্টের প্রথম ফলাফল দেখে বরখাস্ত হন আরিফ হোসেন।
পুলিশ প্রশাসন স‚ত্রে তথ্য পাওয়া যায়, ইতিমধ্যে প্রায় ১০০ জনের ডোপ টেষ্ট করা হয়েছ্ েএদের মধ্যে মাদক সেবনের সঙ্গে যারা জড়িত বলে প্রমাণ পেয়েছে তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে। আরো জানা যায়, গত ৪ জানুয়ারী এসআই আরিফ হোসেনকে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করায় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় খবরটি প্রচার হয়। চাকুরী থেকে বরখাস্ত হওয়ার বিষয়টির সত্যতা জানিয়েছেন আরিফ হোসেন নিজেই। কিন্তু এখন প্রশ্ন ওঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ ছিলেঅ সম্প‚র্ণ মিথ্যা। ডোপ টেষ্টে তাঁর রিপোর্ট পজেটিভ বলে যা উপস্থাপন করা হয়েছে তা মিথ্যা কলঙ্ক ছাড়া কিছু নয় বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। কেনোনা তিনি কখনো হিরোইন বা মাদক সেবন করেননি কিংবা অতীতে কখনো মাদক সেবনের সাথে জড়িত ছিলেন না।
পুলিশ বাহিনীতে চাকুরীর আগে বা চাকুরীরত অবস্থায় পান-সিগারেট ও খাওয়ার তার প্রমাণ নেই। চাকুরী থেকে বরখাস্ত হওয়া এই এসআই আরিফ হোসেন বিষয়টি সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেননি। যেহেতু তিনি মাদক সেবনকারী নয়। অনুসন্ধানে মিলে, বরখাস্তকৃত এসআই আরিফ হোসেন ছিলো অধুমপায়ী। পাশাপাশি একজন নীতিবান সৎ পুলিশ অফিসার ও বটে। যিনি ভাষানটেক থানা থেকে পল্লবী থানায় যোগদান করার পর সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নজরুল ইসলাম তাকে যোগ্য মনে করায় ফোকাল পয়েন্ট অফিসার হিসেবে পল্লবী থানায় দায়িত্ব দেন।
ধারণা করা হচ্ছে, কোন কুচক্রীমহল তাকে পল্লবী থানা থেকে সরানোর জন্য বিভিন্ন ভাবে তার নামে অপ্রচার রটিয়ে বিভিন্ন মোবাইল নাম্বার থেকে সিনিয়র অফিসারদের কাছে এসএমএস করতে থাকেন। পরবর্তীতে ওইসব নাম্বারের অভিযোগের কোন প্রমাণ না মিলায় এবং ওই সব নাম্বার বন্ধ থাকায় সিনিয়র পুলিশ অফিসারেরা বিষযটি বুঝতে পারেন। সম্ভবত হঠাৎ কোন এক অজানা কারণে তাঁকে ডোপ টেষ্ট করানোর জন্য ডাকা হয়। ফলে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ডোপ টেষ্ট করানোর নমুনা দিয়ে আসেন।
কিছুদিন পরে তার ডোপ টেষ্টের রিপোর্ট প্রদান করা হয়। তাতে দেখানো হয় তার শরীরে অধিক পরিমাণে হেরোইনের নমুনা পাওয়া গেছে। এটা দেখে তিনি অবাক হন। তার মনে সন্দেহ জাগে। ভুয়া নাম্বার থেকে সিনিয়র অফিসারদের মোবাইলে মেসেজ পাঠানো ও ডোপ টেষ্টের ফলাফল একই সুত্রে গাথা হতে পারে বলে তার সন্দেহ হয়। নিজের বিবেককে তিনি মানাতে পারেন না। চলে গেলেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডোপ টেষ্ট করাতে। ওখানে তার রিপোর্টে আসে তার শরীরে কোন প্রকারের মাদকের আলামত নেই। এটা দেখার পর সে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ওই রিপোর্টের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করেন। মিথ্যা রিপোর্ট প্রদান করায় মামলা করার কথা জানান।
নিদোর্ষ হয়েও শাস্তি ভোগ করবেন কেন এসআই আরিফ হোসেন? পরে বিষয়টি আমলে নেন পুলিশ কতৃপক্ষ পূনরায় তাঁর ডোপ টেষ্ট করানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে তলব করেন এবং নমুনা নেয়া হয়। কিছুদিন পর একই হাসপাতাল রিপোর্ট প্রদান করে তার শরীরে কোন প্রকার মাদকের রেশ নেই। ফলাফল নেগেটিভ। তার মানে বিনা কারণে তাঁকে অপবাদ দেয়া হয়েছে এবং চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
ওদিকে, পত্রপত্রিকায় দেখে এসআই আরিফ হোসেনকে চেনাজানা তার গ্রামের লোকজন ও অন্যান্য পুলিশ অফিসারেরা জানান আরিফ কখনো মাদকের সাথে জড়িত নন। একাধিক পুলিশ সদস্যরা জানায়, ডোপ টেষ্টকে এখন প্রতিহিংসা পরায়নের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন কিছু অসৎ লোকজন। অনেক ভাল অফিসারদের নাম ডোপ টেষ্টে করানোর তালিকায় দেয়া হচ্ছে। রিপোর্ট পজেটিভ দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। মোটা অংকের লেনদেন রয়েছে কিনা তাও সন্দেহ। এসব বিষয় খুব ভাবিয়ে তুলছে ভালো অফিসারদের।
কারণ ডোপ টেষ্ট নিয়ে চলছে পুলিশের মধ্যে নানা বিতর্ক। শুধু কনস্টেবল, এএসআই, এসআই পদে যারা আছে তাদের প্রতি জুলুম করা হচ্ছে না তো! প্রকৃত মাদকাসক্ত যাঁরা তাদের সনাক্ত না করে নিরীহ পুলিশ সদস্যের উপর দায় চাপিয়ে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করা হলে শুধু ব্যক্তি নয়, দেশেরও ভাবম‚র্তি ও নষ্ট হয় বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন।
প্রসঙ্গত, সরকারি চাকরিতে চ‚ড়ান্ত নিয়োগের আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষার অংশ হিসেবে এখন ডোপ (মাদকদ্রব্য) টেস্টও শুরু হয়েছে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। তবে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) একটি শাখা বর্তমানে সীমিত পরিসরে ডোপ টেস্টের কাজ করছে। এরমধ্যে পুলিশ হাসপাতাল ডোপ টেস্টের সরঞ্জাম বিহীন কিভাবে ফলাফল দিচ্ছেন তাও অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে। বিশেষসুত্র জানায়, পুলিশ হাসপাতালে সরঞ্জাম এখনও কেনা হয়নি। সক্ষমতা নিয়েও নানা কথা রয়েছে। সরঞ্জাম, অভিজ্ঞ প্যাথল্যাজিক্যাল চিকিৎসক কিংবা জনবল না বাড়িয়ে এ প্রক্রিয়া নিয়ে নানা বিতর্ক দেখা দিতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন।
সংশ্লিষ্ট স‚ত্র জানায়, ২০১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে ডোপ টেস্ট (মাদক পরীক্ষা) বাধ্যতাম‚লক করা হয়। এরপর থেকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন শাখায় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ চাকরি প্রত্যাশীদের তালিকা পাঠানো হচ্ছে ডোপ ডেস্টের জন্য। কিন্তু সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এই ডোপ টেস্টে মুখের লালা পরীক্ষার মাধ্যমে শেষ সাত দিন, রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে শেষ দুই মাস, চুল পরীক্ষার মাধ্যমে শেষ ১২ মাস এবং স্প্যাইনাল ফ্লুইড পরীক্ষার মাধ্যমে গত পাঁচ বছরের মধ্যে কেউ মাদক গ্রহণ করলেও তা পরীক্ষায় ধরা পড়বে। কিন্তু বর্তমানে শুধু ইউরিন (ম‚ত্র) পরীক্ষার মাধ্যমে ডোপ টেস্ট করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে কোনও ব্যক্তি শেষ ১০ দিনের ভেতর কোনও মাদক গ্রহণ করেছেন কিনা তা পরীক্ষায় ধরা পড়বে। মাদকদ্রব্য আইন, ২০১৮ এর ধারা ২৪(৪) বাস্তবায়নের জন্য জরুরিভিত্তিতে কমপক্ষে একটি অটোমেটিক ইউরিন (ম‚ত্র) অ্যানালাইজার কেনা জরুরি বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
অপরদিকে, গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানো ও সড়ক দুর্ঘটনা রোধে গত ডিসেম্বর থেকে পরিবহন শ্রমিকদের ডোপ টেস্ট শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরিবহন কর্মীদের আপত্তির মুখে বাস মালিকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের অবস্থান থেকে আপাতত পিছিয়ে আসে। কিন্তু হঠাৎ কোন ঘোষণা নেই, প্রশিক্ষণ নেই, জনবল নেই, সরঞ্জাম নেই! শুরু হলো পুলিশের ডোপ টেষ্ট। এতে অনেক ভালো অফিসারের গায়েও কলঙ্ক তিলক লাগানো হচ্ছে। বরখাস্ত করা হচ্ছে এসআই আরিফ হোসেনের মতো ভালো ও সুদক্ষ পুলিশ অফিসারদের। যারা দেশ, মাটি ও মানুষের জন্য ভালো কিছু করার সক্ষমতা রাখেন। সুতরাং এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের নজর প্রত্যাশা করেছেন অনেকেই।