জাতীয় লিড নিউজ

ধর্ষণের ঘটনায় গর্ভপাতের বৈধতা

সিনিউজ ডেস্ক:

করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির মধ্যেও ধর্ষণসহ নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা বেড়ে চলেছে। এসব ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদ, গ্রেপ্তার- কোনো কিছুতে থামছে না এ ভয়াবহতা। গত বছরের ১৩ অক্টোবর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান যুক্ত করার পরও কমেনি ধর্ষণসহ নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা। এমন পরিস্থিতিতে নারী নির্যাতন দমন আইন ঢেলে সাজানোর কথা ভাবছে সরকার। এ পরিপ্রেক্ষিতে ‘নারী নির্যাতন আইন ২০২১’ নামে নতুন একটি আইনের খসড়াও ইতোমধ্যে তৈরি করা হয়েছে।

প্রস্তাবিত খসড়ায় ধর্ষণের ফলে অন্তঃসত্ত্বা হলে আইনানুগভাবে গর্ভপাতের বিধান এবং ধর্ষণের ফলে জন্ম নেওয়া শিশুর প্রতিপালনের জন্য ধর্ষক পিতা বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি ১৬ বছরের নিচে কোনো শিশুর সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্ক হলে সেটিও ধর্ষণ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এটি কার্যকর হলে দেশের বিচার ব্যবস্থায় নতুন একটি ধারা তৈরি হবে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত আইনে ধর্ষণের ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তে পুলিশের দায়িত্ব ও কর্তব্য, তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সংশ্নিষ্ট চিকিৎসকের জবাবদিহিতার বিষয়েও নানা বিধান যুক্ত করা হয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আইন কমিশনের তৈরি করা ২৯ পৃষ্ঠার প্রস্তাবিত নারী নির্যাতন দমন আইনের প্রেক্ষাপটে বলা হয়েছে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ প্রণয়নের পর প্রথম দিকে কয়েক বছর মোটামুটি প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছিল।

তবে এখন আইনটি প্রণয়নের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য পূরণ সন্তোষজনক নয় বলে সাম্প্রতিক গবেষণা, পর্যবেক্ষণ ও সমীক্ষায় উঠে এসেছে। বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত সাত বছরে ধর্ষণ বা যৌতুকের দাবিতে হত্যার অভিযোগে কয়েক হাজার মামলার মধ্যে ঢাকার চারটি ট্রাইব্যুনালে আসামিদের শাস্তি বা দণ্ড পাওয়ার হার নগণ্য। আইনের অপপ্রয়োগের হারও আশঙ্কাজনক। এ প্রেক্ষাপটে বিচারকদের আসামিদের দোষী সাব্যস্ত করতে ও গুরুদণ্ড আরোপে সাবধানতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। তা ছাড়া ২০১৩ সালে শিশু আইন নামে একটি পৃথক আইন করা হয়েছে, তাই শুধু নারীর বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে নারী নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন।

এ প্রসঙ্গে আইন কমিশনের প্রস্তাবনায় বলা হয়, যেহেতু নারী বলতে সব বয়সের নারী বোঝায়, সেহেতু মেয়ে শিশুরা নারী জাতিভুক্ত এবং নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত বিশেষ অপরাধসমূহ অর্থাৎ ধর্ষণ, শিশুসহ যে কোনো বয়সের নারীর ওপরই সংঘটিত হতে পারে। এ জন্য নারী শিশু ও পুরুষ শিশু উভয় শিশুর ওপরে সাধারণভাবে সংঘটিত অপরাধগুলো একটি পৃথক আইনের আওতাভুক্ত করাই বাঞ্ছনীয়।

জানা গেছে, গত সপ্তাহে ১৩ পৃষ্ঠার প্রস্তাবনা ও ২৯ পৃষ্ঠার প্রস্তাবিত নারী নির্যাতন দমন আইনটি সংসদে বিল আকারে উপস্থাপনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, আইন মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় এখন বিধি অনুসারে আইনটি পর্যালোচনা করে সংসদে উপস্থাপনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। অবশ্য এর আগে বিভিন্ন বিষয়ে আইন কমিশন সুপারিশ পাঠালেও তার অধিকাংশই সরকার কার্যকর করেনি। তবে আইন কমিশন সূত্রে জানা যায়, মাঠপর্যায়ের গবেষণা, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মতামত, দেশ-বিদেশের উল্লেখযোগ্য রায়ের ভিত্তিতে নতুন এই আইনের খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। এটি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার ইতিবাচক পদক্ষেপ।

জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘এখনও আমার নজরে আনা হয়নি। হয়তো দুই-একদিনে এসে যাবে। এটি পেলে পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বলেন, ‘নারী নির্যাতন দমনসহ অপরাধের শিকার নারীর ন্যায়বিচার নিশ্চিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সুষ্ঠু ও দ্রুত তদন্ত। খসড়ায় এটিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এটি সম্ভব হলে নারী নির্যাতন-সংক্রান্ত অপরাধগুলোর তদন্ত ও বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব হবে। অপরাধের শিকার নারীর বিচারপ্রাপ্তি সহনীয় হবে এবং বিচারপ্রার্থী নারীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা, তা কিছুটা হলেও লাঘব হবে।’
ধর্ষণের সংজ্ঞা নির্ধারণ :প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, বিদ্যমান আইনেও ধর্ষণের শাস্তির বিধান রয়েছে; কিন্তু ধর্ষণের সংজ্ঞা ১৮৬০ সালের পেনাল কোডে বর্ণিত সংজ্ঞাই রয়ে গেছে। বিশ্ব পরিস্থিতিতে নানা প্রকৃতির ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। উন্নত বিশ্বগুলোতে অনেক যৌন নির্যাতনকে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। কাজেই বর্তমান বাস্তবতায় ধর্ষণের সংজ্ঞা সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন। তা ছাড়া ধর্ষণ ছাড়াও বিকৃত যৌন অপরাধগুলোও সংজ্ঞায়িত করে শাস্তির আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছে। এ জন্য আইনে ধর্ষণসহ সংশ্নিষ্ট ১৪টি বিষয়কে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

ধর্ষণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- ক. জোরপূর্বকভাবে নারীর ইচ্ছা ও সম্মতি ব্যতিরেকে; বা খ. তাহার সম্মতিতে, কিন্তু এরূপ সম্মতি আদায় করা হয়েছে তাহার অথবা কোনো ব্যক্তি যাহার সঙ্গে তাহার সম্বন্ধ বা সম্পর্ক রয়েছে, এরূপ কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধন বা মৃত্যুর হুমকি দেখিয়ে বা গ. সংশ্নিষ্ট নারীর আপাত সম্মতিতে, যখন সে ভুলক্রমে বা ভ্রান্ত বিশ্বাসে মনে করে যে অভিযুক্ত ব্যক্তি তাহার বৈধ স্বামী, কিন্তু ওই অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজে জানে যে, সে ওই নারীর স্বামী নয় বা ঘ. তাহার সম্মতিতে যখন এই ধরনের সম্মতি মানসিকভাবে অপ্রকৃতিস্থ থাকাবস্থায় বা নেশাগ্রস্ত থাকাকালে বা এমন কোনো মানসিক অবস্থায় দেওয়া হয়েছিল, যখন সে তাহার সম্মতির প্রকৃতি ও পরিণাম বোঝার ব্যাপারে অক্ষম ছিল বা ঙ. তাহার বয়স ১৬ বছরের কম, যদিও তাহার সম্মতি ছিল বা চ. যখন সে তাহার সম্মতি আছে কি নাই তাহা প্রকাশ করতে বা জানাতে অক্ষম।

ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনমূলক অপরাধের দণ্ড :প্রস্তাবিত আইনে চৌদ্দ বছরের কম বয়সী শিশু ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে অনূ্যন ২০ বছর অথবা ৩০ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের কথা বলা হয়েছে। কারও হেফাজতে বা আশ্রয়ে থাকাকালে ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে বলা হয়েছে, কোনো নারী সহকর্মী বা অধস্তন কর্মী বা কোনো নারী তাহার হেফাজতে বা আশ্রয়ে বা আওতাধীন স্থানে থাকাকালে কোনো নারীর অবস্থানের সুযোগ গ্রহণ করে তাহাকে ধর্ষণ করে, সেক্ষেত্রে ওই ব্যক্তি অনূ্যন ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ৩০ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত সর্বোচ্চ অর্থদণ্ড হবে ২০ লাখ টাকা। একইভাবে আইনে আস্থা বা বিশ্বাস ভঙ্গপূর্বক বা সম্পর্কের সুযোগ গ্রহণ করে অথবা সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকালে বা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বা সম্মতি প্রদানে অক্ষম ইত্যাদি ক্ষেত্রে; চৌদ্দ বা তদূর্ধ্ব বয়সী শিশুর সম্মতিক্রমে ধর্ষণ; ধর্ষণের ফলে দীর্ঘস্থায়ী মানসিক বৈকল্য ইত্যাদির শাস্তি; দলবদ্ধভাবে ধর্ষণের শাস্তি; অপরাধীর পুনরাবৃত্তির শাস্তিসহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তি হিসেবে অনূ্যন ১০ বছর কারাদণ্ড থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত শাস্তির কথা বলা হয়েছে।

খসড়ায় ধর্ষণচেষ্টার শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত দুই লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে। আইনে নারীর আত্মহত্যায় প্ররোচনার শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে প্রমাণিত ধর্ষণকারীর অনূ্যন ২০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ৩০ বছর কারাদণ্ড। একইভাবে সালিশ বা ফতোয়াকারীর আত্মহত্যায় ইন্ধন জোগানোর জন্য শাস্তি হিসেবে প্রত্যেককে ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে।

ধর্ষণজাত সন্তানের জন্ম :এ বিষয়ে খসড়ায় বলা হয়েছে, অন্য আইনে যাহা থাকুক না কেন, কোনো প্রাপ্তবয়স্ক নারী যদি ধর্ষণের কারণে অন্তঃসত্ত্বা হন এবং তাতে তাহার স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা না থাকলে গর্ভধারণের ১০ সপ্তাহের মধ্যে তিনি স্বেচ্ছায় গর্ভপাত করাতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার নারীর বয়স যদি ১৮ বছরের কম হয়, তাহলে তাহার নিজের সম্মতির অতিরিক্ত বাবা-মা কিংবা প্রযোজ্য আইনানুগ অভিভাবকের সম্মতি নিতে হবে। তবে গর্ভপাত শুধুমাত্র সরকার স্বীকৃত হাসপাতাল বা ক্লিনিকে সম্পন্ন করতে হবে। এ ছাড়া ধর্ষণের কারণে কোনো সন্তান জন্ম নিলে শিশুটি শুধুমাত্র তার মাতার পরিচয়ে পরিচিত হবেন এবং প্রয়োজনে সরকার ২১ বছর পর্যন্ত তার ভরণপোষণের ব্যয় নির্বাহ করবে। তবে এক্ষেত্রে ২১ বছরের বেশি বয়স্ক কন্যাসন্তানের ক্ষেত্রে তাহার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত এবং প্রতিবন্ধী সন্তানের ক্ষেত্রে তিনি স্বীয় ভরণপোষণের যোগ্যতা অর্জন না করা পর্যন্ত সরকার ব্যয় বহন করবে। উল্লেখিত সন্তানদের ভরণপোষণ বাবদ টাকার পরিমাণ নির্ধারণে সরকারকে বিধি প্রণয়ন করতে হবে। এর আওতায় সরকার ধর্ষকের কাছ থেকে ভরণপোষণ আদায় করতে পারবে, এর প্রয়োজনে ধর্ষকের সম্পদ থেকেও তা আদায় করা যাবে।

খসড়া আইনে ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা সুষ্ঠু ও দ্রুত তদন্তের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এতে ধর্ষণের শিকার নারীর চিকিৎসা, ডাক্তারি পরীক্ষা, অভিযুক্ত ব্যক্তির পরীক্ষা, ডিএনএ পরীক্ষা, অপরাধের শিকার নারীর জবানবন্দি গ্রহণ, ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক জবানবন্দি গ্রহণ, তদন্তের সময়সীমা, তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল পদ্ধতিসহ সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।

প্রস্তাবিত আইন প্রসঙ্গে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও মানবাধিকার কর্মী সালমা আলী বলেন, ৩০ বছর ধরে এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছি। মামলাগুলো পরিচালনা করতে গিয়ে আদালতে আইনের নানা সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হয়েছি এবং হচ্ছি। সেখানে সংশ্নিষ্টদের মতামত না নিয়ে এভাবে আইনের খসড়া তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো সমীচীন হয়নি। এখানে আমাদের মতামত নেওয়া উচিত ছিল। এর আগে নারী ও শিশু বিষয়ে যেসব আইন হয়েছে, তাতে আমাদের মতামত নেওয়া হয়েছিল, এবার তার ব্যতিক্রম হয়েছে।

তবে আইনের প্রস্তাবনার কিছু বিষয়কে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি ধর্ষণের ঘটনায় গর্ভপাত এবং জন্ম নেওয়া শিশুর ভরণপোষণ প্রসঙ্গে সালমা আলী বলেন, এটি অবশ্যই ইতিবাচক। উন্নত বিশ্বে এমন বিধান রয়েছে। ভিকটিম চাইলে এসব বিধান করা যায়, তবে সেটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রয়োগযোগ্য হতে হবে। আশা করছি, তড়িঘড়ি না করে প্রস্তাবিত আইনটি সংসদে উপস্থাপনের আগে আমাদের মতামত নেওয়া হবে। তবেই সেটি প্রয়োগযোগ্য হবে বলে মনে করেন তিনি।

Related Posts