নিজস্ব প্রতিবেদক:
সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে উৎসবের পাশাপাশি উৎকণ্ঠাও বিরাজ করছে। প্রচার-প্রচারণা শুরুর মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় লাশ দেখেছেন মহানগরের ভোটাররা। একের পর এক খুন হচ্ছে-সংঘাত নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
এরই মধ্যে নির্বাচনী সহিংসতায় দুজনের প্রাণ গেছে বন্দর নগরে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও বিএনপির সমর্থকদের সংঘর্ষে আহত হয়েছে শতাধিক। ঘটেছে প্রচারণার গাড়ি ও মাইক ভাঙচুরের ঘটনাও। এসব কারণে সিটি করপোরেশনের ভোটারদের মধ্যে কাজ করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। ভোটকেন্দ্রে যাবেন কি-না, এ নিয়ে নতুন করে চিন্তায় পড়েছেন তারা।
করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিত হওয়ার আগে গত বছরের ১৮ মার্চ রাতে সরাইপাড়া লোহারপুল এলাকায় ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মোরশেদ আকতার চৌধুরীর নির্বাচনী কার্যালয়ে খুন হন আনোয়ার জাহের তানভীর (৪৫) নামের একজন।
১৪ ডিসেম্বর ঘোষিত পুনঃতফসিলে আগামী ২৭ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ধার্য হলে গত ৮ জানুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু হয়। সেদিন নগরের দেওয়ানবাজার এলাকায় নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরীর জনসংযোগে অংশ নিয়ে ফেরার পথে ছুরিকাঘাতের শিকার হয়ে মারা যান ছাত্রলীগ কর্মী আশিকুর রহমান রোহিত। ১২ জানুয়ারি নির্বাচনী সহিংসতায় ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে আজগর আলী বাবুল (৫৫) নামে একজন মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আব্দুল কাদেরহ ১১ জন রিমান্ডে রয়েছেন।
সর্বশেষ শনিবার (১৬ জানুয়ারি) লালখান বাজারে নৌকার প্রচারণায় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। অন্যদিকে হালিশহরে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেনের গাড়িবহরে ভাঙচুরের অভিযোগও পাওয়া যায়।
চট্টগ্রামে গত সপ্তাহে চার দিনের ব্যবধানে খুন হন চারজন। এর মধ্যে বাবুল সর্দার (ওপরে বাঁয়ে) ও আশিকুর রহমান রোহিত (নিচে) মারা গেছেন নির্বাচনী সহিংসতায়
বিভিন্ন সূত্র বলছে, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অস্ত্রধারী এবং শীর্ষ সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি কিশোর গ্যাং লিডারদের প্রভাব বিস্তারের ঘটনা শঙ্কা তৈরি করেছে। নির্বাচনী লড়াইয়ে বেশ ক’জন অভিযুক্তের পাশাপাশি তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী প্রার্থী হওয়ায় এ শঙ্কা আরও বাড়ছে। নির্বাচনে স্থানীয় উঠতি সন্ত্রাসীরাও আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন সাধারণ প্রার্থী ও ভোটাররা।
মূলত কাউন্সিলর পদ নিয়ে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বিভক্ত আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের শক্তি প্রদর্শনের মহড়া নির্বাচন নিয়ে দলটিরই নেতাকর্মীদের উদ্বিগ্ন করছে। সন্ত্রাসী, মাদক কারবারি এবং চাঁদাবাজদের প্রার্থী হওয়ার কারণেও বাড়ছে দুশ্চিন্তা।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কড়া নির্দেশনার পরও সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে বাগে রাখা যায়নি বিদ্রোহী প্রার্থীদের। নির্বাচনে বিএনপিসহ অন্যান্য প্রার্থীর বিরুদ্ধে লড়ার আগে আওয়ামী লীগকে তার দলের বিদ্রোহীদের শক্তি প্রদর্শনের বিরুদ্ধেই লড়তে হচ্ছে। এ নিয়ে সংঘাতের আশঙ্কা করা হচ্ছিল শুরু থেকেই। সম্প্রতি পুলিশের অভ্যন্তরীণ একটি প্রতিবেদনেও ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে কোন্দল এবং দল সমর্থিত ও বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে সংঘাতের আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। এর সবকিছুই ভোটারদের মনে উদ্বেগের দাগকে দীর্ঘ করছে।
শুক্রবার লালখান বাজার ওয়ার্ডে নির্বাচনী গণসংযোগে যান আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী। কিন্তু তার প্রচারণাকে কেন্দ্র করে টাইগারপাস বটতল এলাকায় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে উভয় গ্রুপের প্রায় ১৫ জন কর্মী আহত হন। সংঘর্ষের খবর পেয়ে মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা মাইনুদ্দিন হাসান চৌধুরী, নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন আলম ওই এলাকায় গণসংযোগে অংশ নেননি।
সংঘর্ষের জন্য নিজ দলের নেতা দিদারুল আলম মাসুমকে দায়ী করে কাউন্সিলর প্রার্থী আবুল হাসনাত মো. বেলাল বলেন, ‘কাউন্সিলর পদে দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করছে মাসুমের লোকজন। আজ আমাদের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিমের প্রচারণা উপলক্ষে কর্মীরা জমায়েত হলে মাসুমের অনুসারীরা আমাদের ওপর হামলা করে। এতে আমাদের কর্মী মোজাম্মেল হোসেন সোহাগ, মাহমুদ ও শাহীনসহ ১২ জন আহত হন। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।’
দিদারুল আলম মাসুমের দাবি, নৌকার প্রচারণাকালে কাউন্সিলর প্রার্থী বেলালের কর্মীরা তার লোকজনের ওপর পেছন দিক দিয়ে অতর্কিত হামলা করে।
এর আগে বিকেলে হালিশহর ২৫ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে যাওয়ার পথে গাড়িতে হামলার শিকার হন বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত। তার একান্ত সচিব মারুফুল কবির জানান, গাড়িটি হালিশহর ঈদগাহ রূপসা বেকারির কাছে এলে পেছন থেকে ডা. শাহাদাতের গাড়িতে আঘাত করা হয়। ইট-পাথরের টুকরা দিয়ে গাড়ির পেছনের গ্লাস ভেঙে দেয়া হয়।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, নগরের ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২০টির বেশি ওয়ার্ডে প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন অভিযুক্তরা। এর মধ্যে ২৮ নম্বর পাঠানটুলি ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী র্যাব-পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী, খুন, অপহরণ ও অস্ত্র আইনে এক সময় ২৯টি মামলার আসামি আবদুল কাদের ওরফে মাছ কাদের দলীয় কর্মী হত্যার দায়ে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।