চট্টগ্রাম লিড নিউজ সিটি কর্পোরেশন

সংঘাত-সহিংসতার মধ্য দিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন

নিজস্ব প্রতিবেদক
সংঘর্ষ, সহিংসতা ও প্রাণহানির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ, কেন্দ্রে বাইরে গোলাগুলিতে প্রাণ গেছে একজনের।
নগরীর ৭৩৫টি কেন্দ্রে বুধবার সকাল ৮টায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) এই ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে একটানা চলে বিকাল ৪টা পর্যন্ত।
ভোট চলাকালে লালখানবাজার, পাথরঘাটা আর পাহাড়তলীতে প্রতিদ্বন্দ্বী কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।

এর মধ্যে পাহাড়তলীতে গুলিতে একজন নিহত হন; পাথরঘাটায় ইভিএম মেশিন ভাঙচুর করার অভিযোগে বিএনপি সমর্থিত এক কাউন্সিলর প্রার্থিকে আটক করে পুলিশ।
এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ জন। তাদের ভোটেই সিটি করপোরেশনের নতুন মেয়র, ৩৯ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের ১৪ জন নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হবেন।
নির্বাচনে মেয়র পদে সাতজন প্রার্থী থাকলেও বরাবরের মতই প্রতিদ্বন্দ্বীতা মূল হয়েছে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরী এবং বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী শাহাদাত হোসেনের মধ্যে।
নির্বাচনী কর্মকর্তারা জানান, ইভিএমে ভোট হওয়ায় ফলাফলের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার প্রয়োজন হবে না। কেন্দ্র থেকে ফলাফল এলে এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেশিয়ামে রিটার্নিং কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে তা ঘোষণা করা হবে।
করোনাভাইরাসের মহামারীর কারণে চট্টগগ্রামের সিটি নির্বাচন বিলম্বিত হয়েছে প্রায় আট মাস। তারপর সেই মহামারীর মধ্যেই ভোট হওয়ায় এক ধরনের উদ্বেগ ছিল।
তার ওপর ভোটের প্রচারের সময় প্রতিদ্বন্দ্বী কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও মৃত্যুর ঘটনাও নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছিল।

 

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বুধবার সকালে ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের আমবাগান এলাকায় ইউসেপ স্কুল কেন্দ্রের বাইরে নির্বাচনী সহিংসতার চিত্র। রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামান বলেছিলেন, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরির সব উদ্যোগই তারা নিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৪ হাজার সদস্যও প্রস্তুত রয়েছে। ‘সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ’ ভোট হবে বলেই তিনি আশা করছেন।
তবে ভোটের দিন নগরীর সব জায়গার পরিবেশ শান্তিপূর্ণ থাকেনি। হতাহতের ঘটনার পাশাপাশি অনিয়মের অভিযোগও তোলা হয়েছে বিএনপির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের পক্ষ থেকে।
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের আমবাগান এলাকায় ইউসেপ স্কুল কেন্দ্রের বাইরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত এবং বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে।
সে সময় গুলিতে নিহত হন মো. আলাউদ্দিন আলম নামের ২৮ বছর বয়সী এক যুবক; এক নারীসহ আরও ছয়জন আহত হন।
বিদ্রোহী প্রার্থী মো. মাহমুদুর রহমান নিহত আলাউদ্দিনকে নিজের সমর্থক দাবি করে দায়ী করেছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী মো. ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরীর সমর্থকদের।
তবে কার গুলিতে আলাউদ্দিনের প্রাণ গেছে, সে বিষয়ে কিছু বলতে পারেননি খুলশী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আফতাব হোসেন।
সকালে নগরীর লালখান বাজার ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে এলাকাটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এদিকে নগরীর লালখান বাজার ওয়ার্ডে ভোটের সকালে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বিদ্রোহী প্রার্থীর অনুসারীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। সেখানে আহত হয়েছেন অন্তত ২১ জন।
বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আবদুল হালিম শাহ আলম অভিযোগ করেছেন, ওই ওয়ার্ডের ১৪টি কেন্দ্রের মধ্যে সবগুলো ‘দখল’ করে নিয়েছে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর লোকজন।
আর আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আবুল হাসনাত বেলালের দাবি, তার অনুসারীদের ওপর হামলা হয়েছে বিএনপি প্রার্থীর নেতৃত্বে।
এ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী সাবেক কাউন্সিলর এফ কবির মানিক। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগ নেতা সুদীপ্ত হত্যা মামলার আসামি দিদারুল আলম মাসুম দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
সকাল ৯টার দিকে শহীদ নগর সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে বেলালের সমর্থকদের সঙ্গে মাসুমের সমর্থকদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়।
আর পুলিশ লাইন কেন্দ্র, মাস কিন্ডারগার্টেন কেন্দ্রেও বিএনপি পপ্রার্থীর সমর্থকরা হামলা চালায় বলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল হাসনাত বেলাল অভিযোগ করেন।
অন্যদিকে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী আবদুল হালিম শাহ আলম বলেন, “কোনো কেন্দ্রেই মেয়র ও আমার এজেন্ট ঢুকাতে পারেনি। তারা আমাকেও শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছে। আমাদের ১৫ জন আহত হয়েছে।

খুলশী থানার ওসি শাহিনুজ্জামান বলেন, কেন্দ্রের বাইরে দু’পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছিল। পুলিশ-বিজিবি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে।
এদিকে নগরীর ৩৪ নম্বর পাথরঘাটা ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী ইসমাইল বালিকে দুপুরে আটক করে পুলিশ।
নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) মেহেদী হাসান বলেন, “বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও ইভিএম মেশিন ভাঙচুর ও নির্বাচনী সহিংসতার অভিযোগে তাকে আটক করা হয়েছে।”
বেলা ১১টার পর ব্রিক ফিল্ড রোডে পাথরঘাটা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়।
ওই কেন্দ্রের চারটি বুথের একটিকে ইভিএম মেশিন ভাঙচুর করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে পরে সেখানে ভোটগ্রহণ চালিয়ে নেওয়া হয়।
ভোটের সকালে নগরীর জামালখান, এনায়েতবাজার, আন্দরকিল্লা, পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডের কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে বিএনপির এজেন্টদের দেখা মেলেনি।
কয়েকটি কেন্দ্রে দেখা যায় বাইরে বিপুল লোকজন থাকলেও ভেতরে কম। বিএনপির প্রার্থীরা তাদের এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ করলেও দায়িত্বরত প্রিজাইডিং অফিসাররা বলেছেন, বিএনপির প্রার্থীদের এজেন্টরা ‘আসেননি’।

সকাল সাড়ে ১০টায় নগরীর ১৭ নম্বর পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডের টিচার্স ট্রেনিং কলেজ একাডেমিক ভবন-১ এ ভোট দেওয়ার পর বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন ভোটের পরিবেশ নিয়ে নানা অভিযোগ তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে তার এজেন্টদের ‘বের করে দেওয়া’ হয়েছে, এমনকি এজেন্টদের ‘মারধর’ এবং ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে ‘না দেওয়ার’ অভিযোগও তিনি পেয়েছেন।
“এখন নির্বাচনটা নির্যাতনে, প্রহসনে পরিণত হয়েছে। জাস্ট বলে দিলে হত ভাই মেয়রে ইলেকশন করার দরকার নেই। তাহলে আমি ইলেকশন করতাম না।
“এই যে একটা প্রহসনের নির্বাচন। জনগণকে ধোঁকা দেওয়া, তাদের গায়ে হাত দেওয়া। নির্যাতন করা। বাংলাদেশের মানুষ অনেক ইমোশনাল। তারা কিন্তু জেগে উঠবে। যখন জেগে উঠবে তখন ভয়ঙ্কর হবে।”

 

Related Posts