সিনিউজ ডেস্ক:
সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এবং গাজীপুরে বিষাক্ত মদ পান করে মারা গেছেন বেশ কয়েকজন। ঢাকার বাইরে একই কারণে বগুড়া ও রাজশাহীতেও প্রাণ হারিয়েছে অনেকে। এ ঘটনায় তোলপাড় পুরো দেশ। তবে রাজধানীর বিষয়টি তলিয়ে দেখলে একটু ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়। ঢাকায় যারা মারা গেছেন তাদের সবাই বিদেশি মদ ভেবে বিষ খেয়েছেন। এছাড়া বয়সে তারা অধিকাংশ তরুণ। পেশায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, প্রতিষ্ঠানের উচ্চ কর্মকর্তা-কর্মচারী বা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী। এখনো যারা গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন তারাও মৃত ব্যক্তিদের সহকর্মী, সহযোগী বা সহপাঠী।
ঢাকার ঘটনার আগ পর্যন্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘চোলাই’ বা ‘বাংলা মদে’ বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর খবর পাওয়া যেত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। কিন্তু রাজধানীর ঘটনাটিতে পাওয়া গেছে নির্দিষ্ট করে বিদেশি মদের বিষয়টি।
ঘটনার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত কয়েক মাস ধরে রাজধানীর বার, রেস্তোরাঁ এবং ওয়্যার হাউজগুলোতে বৈধ মদের সংকট দেখা দিয়েছে। করোনার কারণে সেটি আরো প্রকট আকার ধারণ করে। এমনকি বৈধভাবে বিদেশি মদের আমদানিও কমে গেছে। একই সঙ্গে ওয়্যার হাউজগুলোতে এসব মদ বিক্রির ওপর ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ করেছে সরকার। যার কারণে দেখা দিয়েছে বিদেশি মদের সংকট। এই সুযোগে প্রতারক চক্র বিদেশি মদের নামে তৈরি করেছে রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রিত বিষাক্ত তরল। এসবই পান করে প্রাণ হারিয়েছে ভুক্তভোগীরা।
এমনকি এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার লোভে বিষাক্ত মদ তৈরির কারখানা পর্যন্ত খুলে বসে। এর পেছনে কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদেশি মদের বিষয়ে ভোক্তাদের আছে অগাধ আস্থা। এটির মধ্যে বিষ থাকতে পারে, এমন ধারণা সাধারণত ভোক্তাদের মধ্যে নেই বললেই চলে। এসব বিচারেই চক্রটি বিদেশি ব্র্যান্ডকেই বেছে নিয়েছে। এছাড়া হাতের নাগালেই বিভিন্ন ভাঙারি দোকানে পাওয়া যায় নামিদামি বিদেশি ব্যান্ডের মদের খালি বোতল। এসব তৈরিতে রেক্টিফাইড স্পিরিটও সহজে পাওয়া যায় পুরানো ঢাকার রাসায়নিক বিক্রির দোকানগুলোতে। এমনকি দামের সাশ্রয়ের জন্য ইথানলের জায়গায় মেশাচ্ছে বিষাক্ত মিথানল। যার পরিণতিতে এত সব মৃত্যু দেখতে হলো।
এখন পর্যন্ত দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়া এ চক্রের সদস্যরা কেউ ছিলেন ভাঙারির দোকানদার, কেউ-বা ওয়্যার হাউজের সাবেক কর্মী। ফলে সমন্বিত একটি চক্র গড়ে ওঠে এটিকে ঘিরে।
বিশ্লেষকদের মতে, যারা মদপান করেন তাদের বেশির ভাগই সেটি অবৈধভাবে পান করেন। পাশাপাশি অনলাইনের মাধ্যমে খুব সহজেই সেটি সংগ্রহ করতে পারছেন।
এর জন্য সরকার, দেশের আইন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীদের শিথিলতাকে দায়ী করছেন তারা।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপ-কমিশনার (গুলশান বিভাগ) মশিউর রহমানের সঙ্গে। জাগরণকে তিনি বলেন, “সম্প্রতি একটি অসাধু চক্র পরিচিত বিদেশি মদের ব্র্যান্ড ‘অ্যাবসুলেট ভোদকা’, ‘হান্ড্রেড পাইপারস’, ‘ভ্যাট সিক্সটি নাইন’, ‘পাসপোর্ট’, ‘স্যার পিটারসন’, ‘ব্ল্যাক লেভেল’, ‘জ্যাক ডেনিয়াল’সহ বিভিন্ন নামের লেবেল লাগিয়ে মানুষকে পুরানো ঢাকার মিটফোর্ড থেকে নেওয়া তরল বিষ খাওয়াচ্ছিল। যারা এসব খেয়ে মারা গেছেন তারা দেশের বড় বড় অ্যাড কোম্পানি, বায়িং হাউজে কর্মরত ছিলেন। এসব ঘটনায় তরল বিষ বিক্রেতা যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী পানকারীও।”
মশিউর রহমান মন্তব্য করেন, “আমাদের দেশে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া মদপান করা আইনত নিষিদ্ধ। এটি পান করার জন্য অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু সম্প্রতি অনেকে সেই আইন ভঙ্গ করে অনলাইনের মাধ্যমে অপরিচিত লোকের কাছ থেকে বিষাক্ত মদ কিনে নিজে খেয়েছে এবং বন্ধুদের খাইয়েছে। এই যে সে নিজে মরলো, অন্যদেরও মারলো— এর দায় কিন্তু তার ওপরও পড়ে।”
কিছু ব্যতিক্রম বিষয়টি কী— এমন প্রশ্নের উত্তরে ডিবি উপ-কমিশনার বলেন, “আমাদের দেশের কিছু সম্প্রদায়, যেমন : ডোম, মেথর, কুলি, মুচি বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ নানা উৎসব-পার্বণে মদপান করেন। এটা তাদের বহু বছরের কৃষ্টি-সংস্কৃতির অংশ। তাই তাদের এই সুবিধা আছে। এছাড়া কিছু রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শে মদপানের অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু আমার ধারণা সম্প্রতি যারা মদপান করে মারা গেছেন তাদের কারো সেই অনুমোদন ছিল না।”
ডিবি’র উপ-কমিশনার আরো বলেন, “একটা সময় মদ খেয়ে দরিদ্র মানুষরাই মরতেন। কারণ তারা স্থানীয়ভাবে তৈরি করা কম দামি মদ খেতেন। কিন্তু এবারের ঘটনায় যারা মারা গেছেন, তারা ধনী বা উচ্চ মধ্যবিত্ত। এরা সবাই বেশি দাম দিয়ে বিদেশি মদ কিনেছেন। কারণ এদের পকেটে যেমন টাকা আছে, তেমনি মানসিক বিকৃতিও আছে।”
একই সূত্র থেকে সবাই এই বিষাক্ত মদ গ্রহণ করেছেন। এর পেছনে বিদেশি পণ্যের প্রতি আস্থার বিষয়টি কাজ করে থাকতে পারে বলে ধারণা করেন তিনি।