নিজস্ব প্রতিবেদক
লালদিয়ারচরের ১৪ হাজার বাসিন্দা ছুটছেন অজানা গন্তব্যে। নিজেরাই নিজেদের ঘরবাড়ি ভেঙ্গে ফেলেছেন। তাছাড়া তাদের অন্য কোন উপায় ছিল না।
হাজার ৩০০ পরিবারের (১৪ হাজার মানুষ) কাউকেই পুনর্বাসন না করে চট্টগ্রাম বন্দরের ১৩২ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছে সংস্থাটি। বুলডোজার দিয়ে ভাঙার আগেই নিজেদের শেষ সম্বলটুকু গুছিয়ে নিয়ে চলে যায় নগরীর দক্ষিণ পতেঙ্গায় অবস্থিত লালদিয়া চরে প্রায় পাঁ১৪ চ দশক ধরে বসবাস করা মানুষগুলো। পরবর্তী গন্তব্য কোথায় অনেকেরই তা জানা নেই।
পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল সোমবার সকাল ৮টা থেকে লালদিয়া চরে উচ্ছেদ অভিযানে নামে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। তার আগেই গত ১৮ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি জারি করে চরের ৫২ একর জায়গার মানুষের পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিছু আওয়ামী লীগ নেতা অবশ্য পুনর্বাসনের আগে উচ্ছেদ নয় বলে মৃদু কণ্ঠে দাবি জানালেও শেষ মুহূর্তে এসে তারাও চুপসে যান। সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধনে নেমেও সুবিধা করতে না পেরে তিন দিন আগে থেকে চরের বাসিন্দারা নিজেরাই ভাঙতে শুরু করে নিজেদের ঘরবাড়ি। গতকাল ঘরহারা এসব মানুষ মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নেয়
এদিকে লোকজন নিজেরাই ঘরবাড়ি ভেঙে চলে যাওয়ায় অভিযানে বুলডোজার নেয়নি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। তবে সংঘর্ষের আশঙ্কায় দুই শতাধিক পুলিশ, র্যাব ও বন্দরের নিরাপত্তা কর্মী মোতায়েন ছিল। স্থানীয় বোটক্লাবের মাঠে তাদের প্রস্তুত রাখা হয়। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে জায়গাটি খালি করে কাঁটাতারের বেড়া দেবে বন্দর। লালদিয়া চরের ১২নং পুরাতন এয়ারপোর্ট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, উচ্ছেদের জন্য চিহ্নিত এলাকার ৮০ শতাংশ ঘরই সেমিপাকা।
বাকিগুলোও টিন কিংবা কাঠের তৈরি। হাসিনা আক্তার নামে বছর বত্রিশের এক নারী আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমি পঙ্গু মানুষ। ভিক্ষা করে চলি। আমার তিনটা সন্তান। স্বামী বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেছে। এখন আমি সন্তানদের নিয়ে কোথায় যাব?’ আয়েশা বেগম নামে আরেক নারী বলেন, ‘আমার স্বামী লোকমান নামের একজনের কাছ থেকে ওই একতলা বাড়িটি কিনেছিল। তখন তারা জায়গার কাগজপত্র দিয়েছে। এখন বন্দর বলছে এসব খাস জমি। আমরা পথে বসে গেছি। উপায় না দেখে নিজেরা শ্রমিক দিয়ে শেষ সম্বল ঘরটি ভাঙছি।’
শামীমা নামে আরেক নারী বলেন, ‘সরকার রোহিঙ্গাদের সব দিচ্ছে। অথচ আমাদের মতো গরিবদের ওপর বুলডোজার চালানোর ভয় দেখায়।’ তার কথা শেষ হতে না হতেই পাশে থাকা হাসিম আলী নামে একজন ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘আপনারা (সংবাদকর্মী) আমাদের অসহায়ত্ব দেখে মজা পাচ্ছেন। ক্যামেরা নিয়ে আমাদের ছবি তুলছেন। এতে কি আমাদের পুনর্বাসন করবে সরকার? এসব নাটক আমরা বুঝি। আপনারা এখান থেকে চলে যান।’ তবে সৈয়দুল বশর নামে এক বৃদ্ধ বলেন, ‘আমরা কখনোই ভাবিনি এখান থেকে উচ্ছেদ হতে হবে। অনেক টাকা লোকসান হয়ে গেছে রে বাবা।’
লালদিয়া চর পুনর্বাসন বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক আলমগীর হাসান বলেন, ‘পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা না করেই আমাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। বন্দরের এ উচ্ছেদ অভিযানের কারণে আমরা ১৪ হাজার মানুষ পথে বসতে যাচ্ছি। গত ২০ দিন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছি। অহিংস আন্দোলন করেছি। এত কিছুর পরও প্রশাসনকে আমাদের পাশে পাইনি।’
চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘বন্দরের ১৩২ বছরের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড় উচ্ছেদ অভিযান। ছয়টি জোনে ভাগ করে ছয় ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্ব দিলেও, ওখানকার বাসিন্দারা নিজ থেকেই সরে যাচ্ছে। তবুও পুলিশ, র্যাব, আনসার সদস্য, বন্দর, ওয়াসা, পিডিবিসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা রয়েছে। তারা বিষয়টি তদারকি করছেন। এখনো পর্যন্ত কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।’
পতেঙ্গার লালদিয়া চরটি বন্দরের জায়গা উল্লেখ করে সংস্থার চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, ‘আমরা উদ্বুদ্ধ করেছি যাতে বাসিন্দারা স্বেচ্ছায় চলে যায়। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৯০ ভাগ চলেও গেছে এরই মধ্যে। বল প্রয়োগের প্রয়োজন নেই। আমাদের এলাকায় বেড়া দিয়ে দেব, যাতে কেউ দখল করতে না পারে। আনসাররা পাহারা দেবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণ প্রস্থানের ব্যবস্থা করছি। এটি উদাহরণ হয়ে থাকবে। আমাদের লক্ষ্য অর্জন হয়ে গেছে। বুলডোজার বা স্ক্যাভেটর দিয়ে ভাঙার অভিপ্রায় নেই। তারা গরিব হলেও আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তারা ঢিল পর্যন্ত ছোড়েনি। শুধু সময় চেয়েছে। আমরা মালামাল সরিয়ে নেওয়ার সময় দিয়েছি। তাদের বলেছি প্রয়োজনে শ্রমিক ও যন্ত্রপাতি সহায়তা দেব।’
আগে কেন উচ্ছেদ হয়নি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এ জায়গার মালিক বন্দর কর্তৃপক্ষ। পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের সম্প্রসারণের জন্য এখন জায়গাটা আমাদের প্রয়োজন। এর আগে ২৬ একর উচ্ছেদ করেছি। ৫২ একর জায়গা এখন পুনরুদ্ধার করতে পারব। অবৈধ দখল উচ্ছেদ হলে সরকার তৃণমূলদের জন্য জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে থাকে। তাদেরও সহায়তা করার জন্য আমরা তালিকা পাঠিয়েছি।’
১৯৭২ সালে বিমানবাহিনীর জহুরুল হক বিমান ঘাঁটি সম্প্রসারণের কারণে সেখানকার বাসিন্দারা লালদিয়া চরে নতুন বসতি স্থাপন করে। ২০০৫ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সেই চরে প্রথম উচ্ছেদ অভিযান চালায়। ইনকনট্রেড লিমিটেডের একটি কন্টেইনার ডিপো স্থাপনের জন্য ওই সময় ৫০০ পরিবারকে সরিয়ে দেয়। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১৯ সালের ২২ জুলাই ২৫০ স্থাপনা উচ্ছেদের মাধ্যমে প্রায় ২০ একর জমি দখলমুক্ত করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
এদিকে ১০ বছর আগে কর্ণফুলী নদী রক্ষায় নির্দেশনা চেয়ে রিট করে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ১৬ অগাস্ট দেওয়া এক রায়ে উচ্চ আদালত নদীটির তীরে থাকা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেন। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করছে। সর্বশেষ লালদিয়া চরের ৫২ একর ভূমিতে বাস করে আসছিল ২ হাজার ৩০০ পরিবারের অন্তত ১৪ হাজার সদস্য। তাদের উচ্ছেদ করে ৮ মার্চের মধ্যে সেই অভিযানের বিস্তারিত প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করতে হবে।