সিনিউজ ডেস্ক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনে প্রস্তুত জাতি। দেশজুড়ে চলছে নানা আয়োজন।
করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে থমকে গিয়েছিল সব আয়োজন; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর উদযাপন গত এক বছর ধরে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ ছিল, তার মাঝেই বাঙালির জীবনে এল উদযাপনের আরেক মাহেন্দ্রক্ষণ, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী।
এ দুই বিশেষ উপলক্ষ ঘিরে বুধবার বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে শুরু হচ্ছে জাতীয় পর্যায়ে দশ দিনের অনুষ্ঠানমালা, যা শেষ হবে ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির দিনে।
জাতীয় প্যারেন্ড গ্রাউন্ডে ১০ দিনের এই অনুষ্ঠানমালার পাঁচ দিনের আয়োজনে যোগ দেবেন প্রতিবেশী পাঁচ দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান।
মহামারীর কারণে ওই পাঁচ দিনের আয়োজনে সর্বোচ্চ পাঁচশ জন আমন্ত্রিত অতিথি অংশ নিতে পারবেন। অনুষ্ঠানে আসার আগে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে যে তিনি সংক্রমিত নন।
বাকী পাঁচদিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের কেউ জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে থাকবেন না; শিল্পীদের পরিবেশনা সেখানে থেকে টেলিভিশন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারে সীমাবদ্ধ থাকবে।
মঙ্গলবার এ আয়োজনের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতির দিনে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মহড়ায় অংশ নিয়েছেন শিল্পী ও কলাকুশলীরা।
জোড়া উদযাপন ঘিরে ওই এলাকা সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে; রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে টানানো হয়েছে প্রচুর ব্যানার-ফেস্টুন। বিভিন্ন ভবনে হয়েছে আলোকসজ্জা।
’মুজিব চিরন্তন’ প্রতিপাদ্যে ১০ দিনের এই আয়োজনে বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনের ধারাবাহিকতা তুলে ধরার পাশাপাশি সামনে আনা হবে গত ৫০ বছরের ’স্বপ্নযাত্রার’ গল্প।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মেলবন্ধনে ’অনন্য সময়’ পার করছে বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্নের যাত্রা শুরু করেছিলেন, সোনার বাংলা গঠনের জন্য সেই স্বপ্নযাত্রার আরেকটি পর্যায়ের সঙ্গে মেলবন্ধন।
”এই মেলবন্ধন আমাদের শ্রদ্ধার, আমাদের ভালোবাসার মেলবন্ধন, আমাদের অগ্রগতির মেলবন্ধন। এভাবে ১০ দিনের যে প্রোগ্রামটা সাজানো হয়েছে, প্রতিদিনই বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম, তিনি বিভিন্ন সময়ে যে অবদান রেখেছেন, সেগুলো যতটুকু সম্ভব তুলে ধরা। কেননা এই মহাকাব্যিক জীবনকেতো আমরা ১০ দিনের মধ্যে তুলে ধরতে পারব না।”
বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার এই থিমে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ড এলাকায় গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তুলে ধরার পাশাপাশি উন্নয়নের নানা দিকও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়ের ভাষণের উদ্ধৃতি ছাড়াও জাতির পিতার তর্জনীর ছবি কিংবা শিল্পকর্মের প্রাধান্য পেয়েছে ব্যানার, ফেস্টুন আর বিলবোর্ডে।
প্যারেড গ্রাউন্ডে বুধবার বিকেলে ৪টায় মূল আয়োজনের সূচনা হবে। আলোচনাপর্ব শেষে রাত ৮টা পর্যন্ত চলবে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।
শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি
মঙ্গলবার দুপুরে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে মহড়ায় অংশ নেন দেশ-বিদেশের শিল্পী আর কলাকুশলীরা।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে সাংস্কৃতিক উপ-কমিটির প্রধান আসাদুজ্জামান নূর সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের প্রস্তুতি এখন শেষ পর্যায়ে। আমাদের প্রথম দিকে যে প্রস্তুতি ছিল, সেটা পুরোটাই ছিল ভার্চুয়াল।
”পরে এখানে কিছু পরিবর্তন আসে। সেই পরিবর্তনগুলো হল আমাদের বেশ কিছু বন্ধুরাষ্ট্রের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান সশরীরে উপস্থিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তাতে করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন করে অনুষ্ঠানগুলো সাজানোর নির্দেশ দেন।”
১০ দিনের সাংস্কৃতিক আয়োজনে সব মিলিয়ে পাঁচ হাজারের মত শিল্পী ও কলাকুশলীর অংশগ্রহণ থাকছে বলে জানান সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী নূর।
দুপুরের দিকে ভারতের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী ও অভিনেত্রী মমতা শংকরের নির্দেশনায় নৃত্যশিল্পীরা নাচের মহড়ায় অংশ নেন।
বুধবারের সাংস্কৃতিক আয়োজনে তার এই দল ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবর’সহ কয়েকটি গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করবে।
মমতা শঙ্কর সাংবাদিকদের বলেন, “কখনো ভাবিনি ’শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবর’ গানটির নিয়ে কাজ করার সুযোগ পাব। এই বাংলাদেশের মাটিতেই আমার শেকড়।
”আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি সবই এক। তাই একটা টান সবসময় অনুভব করি। আর এমন একটি আয়োজনে অংশগ্রহণ অনন্য পাওয়া।”
অভিনেতা-নির্দেশক তারিক আনাম খানের নির্দেশনায় ’সঞ্চালনা ড্রামার’ মহড়া করেন বেশ কয়েকজন শিল্পী। তাদের এই পরিবেশনায় জাতির জনকের আজীবন সংগ্রামের ধারাবহিকতা তুলে ধরা হবে।
অনুষ্ঠানের এ আয়োজন নিয়ে কামাল চৌধুরী বলেন, “আমাদের স্বপ্নের ভেতরে, আকাঙ্ক্ষার ভেতরে, আমাদের সৃজনে, আমাদের মননে, আমাদের ভালোবাসায়-শ্রদ্ধায় বঙ্গবন্ধু আমাদের কাছে চিরন্তন আলোকশিখা হিসাবে থাকবেন।
”তার তর্জনীর ইঙ্গিতে বাঙালি জেগে উঠেছিল। আমি মনে করি, আমাদের তরুণ প্রজন্ম তার সেই তর্জনীর কাছ থেকে, তার সাহসের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পাবে। এভাবে পুরো বিষয়টাকে চিন্তা করে আমরা ১০ দিনের অনুষ্ঠান সাজিয়েছি।”
প্রথম দিনের আয়োজন
বুধবার বিকেল ৪টায় জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে শিশুদের কণ্ঠে জাতীয় সংগীতের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে ১০ দিনের আয়োজনের সূচনা হবে।
শিশুশিল্পীদের সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত এবং এর পর শত শিশুশিল্পীর সংগীত পরিবেশনার মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হবে।
মুজিববর্ষের থিম সংয়ের মিউজিক ভিডিও পরিবেশনার পর বিমানবাহিনীর ফ্লাই পাস্টের রেকর্ড করা ভিডিও প্রচার করা হবে।
এরপর স্বাগত সম্ভাষণ জানাবেন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম।
প্রচারিত হবে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইউশিহিদে সুগার ধারণ করা ভিডিও বার্তা।
চীনের রাষ্ট্রদূত তার দেশের উপহার হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধুর যে আবক্ষ ভাস্কর্য হস্তান্তর করেছেন, তার ভিডিও দেখানো হবে অনুষ্ঠানে।
’সম্মানিত অতিথি’ মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহর বক্তব্যের পর প্রধান অতিথির ভাষণ দেবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
এরপর অতিথিদের ‘মুজিব চিরন্তন’ শ্রদ্ধা-স্মারক উপহার দেওয়া হবে।
অনুষ্ঠানের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আলোচনা পর্ব শেষ হবে।
দ্বিতীয় পর্বে সাংস্কৃতিক আয়োজনে দেশীয় শিল্পীদের পাশাপাশি একটি বড় অংশজুড়ে থাকবে ভারতের শিল্পীদের পরিবেশনা।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্বে ‘ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়’ থিমের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত অডিও-ভিজ্যুয়ালে ফুটে উঠবে জাতির পিতার সংগ্রামী জীবনের নানা অধ্যায়।
অর্কেস্ট্রা মিউজিকের সঙ্গে গান পরিবেশনা, বঙ্গবন্ধুকে প্রতীকী চিঠি উৎসর্গ, ‘মুজিব শতবর্ষের কার্যক্রম ফিরে দেখা’ শীর্ষক ভিডিও দেখানো হবে এ সময়।
এ পর্বে পরিবেশিত হবে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সব গান। সংগীত পরিবেশন করবেন সাদি মোহাম্মদ, রফিকুল আলম, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, শিমূল ইউসূফ।
তারা শোনাবেন ‘জাত গেল জাত গেল’, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তব একলা চল রে, ধনধান্য পুষ্প ভরা’সহ কয়েকটি সমবেত গান।
বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করে বন্ধু রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় থাকছে ভারতের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী মমতা শঙ্করের নেতৃত্বে একটি বিশেষ পরিবেশনা।
বর্ণিল আতশবাজি ও লেজার শোর মাধ্যমে রাত ৮টায় শেষ হবে প্রথম দিনের আয়োজন।
আসাদুজ্জামান নূর বলেন, “আমাদের দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের যে মহান সংগ্রাম, স্বাধীনতার আগ থেকে শুরু করে, সেই সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, তার ত্যাগ, তার সাহসিকতা এবং ফাঁসির মুখোমুখি হয়েও তার যে আপসহীন মনোভাব, যার মধ্য দিয়ে আমরা মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গিয়েছি, সেটা আমরা তুলে ধরব।
”অন্যদিকে, নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা, গণমানুষের যে ত্যাগ সেটা আমরা তুলে ধরতে চাই। এর বিনিময়ে আজকের যে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে, গর্ব নিয়ে অহঙ্কার নিয়ে, এটা আমরা তুলে ধরতে চাই।”