কলকাতা প্রতিনিধি
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদকে আরও কতদিন ভারতে থাকতে হবে? তিনি কি সহসা দেশে ফিরতে পারবেন? অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের দায় থেকে মুক্তি পেলেও কেন তিনি দেশে ফিরতে পারছেন না? এই প্রশ্ন বিএনপির নেতাকর্মী ও তার স্বজনদের। অনুপ্রবেশের দায় থেকে ভারতের শিলংয়ের আদালত তাকে মুক্তি দিলেও দেশটির রাষ্ট্রপক্ষের পাল্টা আপিলে থমকে গেছে সালাউদ্দিন আহমেদের দেশে ফেরা। সব মিলিয়ে প্রায় ছয় বছর ধরে মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ে আটকে আছেন বিএনপির সাবেক এই টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী। দীর্ঘদিনের নিঃসঙ্গ জীবনে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন তিনি।
বিএনপির এই নেতার পরিবার জানিয়েছে, অনুপ্রবেশের মামলা থেকে বেকসুর খালাস পেয়েছে সালাউদ্দিন আহমেদ। কিন্তু সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে দেশটির রাষ্ট্রপক্ষ। আদালতে আপিলের পর সেটার আর নড়াচড়া নেই। ওভাবেই কাগজ পড়ে আছে। করোনার কারণে দেশটির আদালতের কার্যক্রম কার্যত বন্ধ।
বৃহস্পতিবার সালাউদ্দিনের স্ত্রী হাসিনা আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ওনার (সালাউদ্দিন) কথা কি কারও মনে আছে? আমাদের সংসারটা কেমন করে যাচ্ছে আল্লাহ ছাড়া চিন্তা করার মতো আর তো কেউ নেই। কারণ, এমন একটা মানুষ এ রকমভাবে এমন একটা জায়গায় গিয়ে পড়েছে- যেখানে তিনি নিঃসঙ্গ একাকি জীবন-যাপন করছেন। আজ ছয়-সাতটা বছর ধরে উনি কীভাবে বেঁচে আছেন, সুস্থ না অসুস্থ আমরা এগুলো জানি না। এসব কথা মানুষের কাছে বলতে গেলে সবাই লাথি মারে! আল্লাহ ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই।’
জানা গেছে, বিএনপির এই নেতার শারীরিক অবস্থা আগের তুলনা আরো খারাপ হয়েছে। কিডনি, হার্টে সমস্যা ও ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছেন তিনি। শিলংয়ে অবস্থানকালে তিনি কিডনি ও মূত্রথলিতে অস্ত্রোপচার করিয়েছেন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালের শেষের দিকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন উত্তাল, বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অনেকে জেলে, কেউ কেউ আত্মগোপনে, তখন দলের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করেন তখনকার যুগ্ম মহাসচিব সালাউদ্দিন আহমদ। পরের বছর ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি সামনে রেখে আবার সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামে বিএনপি ও ২০ দল।
টানা অবরোধ কর্মসূচির সময় গ্রেপ্তার এড়াতে সালাউদ্দিন অজ্ঞাত স্থান থেকে গণমাধ্যমে পাঠাতেন দলের বিবৃতি ও ভিডিও বার্তা। বেশ কিছুদিন এভাবে চলার পর ওই বছরের ১০ মার্চ রাতে ঢাকার উত্তরা এলাকার একটি ভবন থেকে ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী’ পরিচয়ে একদল অস্ত্রধারী তাকে ‘অপহরণ’ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। নিখোঁজের দুই মাস পর মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ের একটি রাস্তা থেকে মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় পুলিশ।
সালাউদ্দিনের স্ত্রী সাবেক সংসদ সদস্য হাসিনা আহমেদ বলেন, ‘ওনার (সালাউদ্দিন) শারীরিক অবস্থা আগের মতোই খারাপ। কোথাও গিয়ে ডাক্তার দেখাবেন সেই অবস্থাটুকুও এখন নেই। আর একা একা কোনো মানুষ যদি কোথাও পড়ে থাকে সে-কি সুস্থ থাকতে পারে? শিলংয়ে তার একাকি নিঃসঙ্গ দিন কাটছে।’
সাক্ষাতের জন্য আগে ভারত যাবার সুযোগ ছিল কিন্তু বর্তমানে তা বন্ধ রয়েছে বলে জানান হাসিনা আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এখন অনেক দিন ধরে যেতে পারছি না। করোনার কারণে সেখানে (ভারতে) লকডাউন চলছে। তাই যাওয়া-আসা আরো কঠিন হয়ে গেছে। মেডিকেল ভিসা বা বিজনেস ভিসা ছাড়া যাওয়া খুব কঠিন। আর করোনার মধ্যে ছেলে-মেয়েদের রেখে সেখানে যেতে পারছি না। ওরা তো ছোট।’
ফিরতে বাধা কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওখানকার সরকারের কাছে আপিল করা হয়েছিল। আপিলের পর সেটার আর মুভমেন্ট নেই। ওভাবেই কাগজ পড়ে আছে। এখন দেশটির সরকারের ব্যাপার। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। করোনার কারণে ওখানের কোর্ট-কাচারিও সব বন্ধ। কেউ কিছু করতে পারছে না। সেহেতু আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার নেই।’
অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলায় সাড়ে তিন বছর পর ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর বেকসুর খালাস পান সালাউদ্দিন আহমেদ। তবে পাসপোর্ট ও ভিসা না থাকায় তাকে ভারতেই অবস্থান করতে হয়। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ২৭ এপ্রিল রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে দেশটির রাষ্ট্রপক্ষ। পরবর্তীতে করোনা সংক্রমণের কারণে দেশটির আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় থেমে আছে সালাউদ্দিনের দেশে ফেরা না ফেরার সিদ্ধান্ত। আবার ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফেরানোর মতো আসামি নন বিএনপির এই নেতা। তাই দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আলোচনা ও সম্মতির মাধ্যমে তাকে দেশে ফিরতে হবে বলে ঢাকাটাইমসকে জানান পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
সালাউদ্দিনকে ফেরাতে কোনো রাস্তাই বাদ রাখেননি জানিয়ে হাসিনা আহমেদ বলেন, ‘কোন কিছুই বাদ রাখিনি। এখন আপিল যতদিন মুভমেন্ট না হবে, আইনি প্রক্রিয়া যতদিন শেষ না হবে ততদিন আমাদের আর কিছু করার নেই। একসময় আইনি প্রক্রিয়ায় গাফলতি ছিল, এখন করোনার জন্য সেটা আরো পিছিয়ে গেল। কি হবে এটার ভবিষ্যৎ সেটা আল্লাহ জানেন। সব কিছু এখন আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছি। তিনি যদি সহায় হন তাহলে নিজ দেশে ফিরতে পারবেন। না হলে….।’ তিনি সকলের কাছে দোয়া চান।
দেশে সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে যেসব মামলা ছিল সেগুলো এখন কী অবস্থা জানতে চাইলে তার স্ত্রী বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে যেসব মামলা ছিল সেগুলো এখন আইনজীবীরাই দেখছেন। পার্টির পক্ষ থেকে আগে ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) এড. সানাউল্লাহ মিয়াকে দেখতে বলেছিলেন। তিনি মারা যাবার পরে অন্য একজন মামলাগুলো দেখছেন।’ চার সন্তানের মধ্যে দুইজন দেশের বাইরে থাকেন। আর বাকি দুজনকে নিয়ে রাজধানীতেই থাকেন হাসিনা আহমেদ।
কিভাবে এলেন রাজনীতিতে:
১৯৯১-৯৬ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এপিএস ছিলেন সালাউদ্দিন আহমেদ। পরে তিনি চাকরি ছেড়ে কক্সবাজারের সংসদ সদস্য হন এবং ২০০১-০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদও সংসদ সদস্য ছিলেন। নিখোঁজ হওয়ার সময় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাউদ্দিন আহমেদ পরে ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে পদোন্নতি পান। এছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার এককালের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র সালাউদ্দিন আহমেদ। ২০১৫ সালের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফরে এলে বিএনপি চেয়ারপারসন তাঁর (মোদি) সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেসময় খালেদা জিয়া সালাউদ্দিন আহমেদের বিষয়টি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
সালাউদ্দিনের নামে ২৭ মামলা:
বিএনপির এই নেতার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় ২৭টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে অবরোধের সময় বেশ কয়েকটি মামলা হয়। বিস্ফোরক দ্রব্য, বিশেষ ক্ষমতা আইন ও হত্যার অভিযোগে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় তিনটি, বিস্ফোরক আইন ও হত্যার ঘটনায় রামপুরা থানায় দুটি, বিস্ফোরক আইন ও পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার ঘটনায় ভাটারা থানায় দুটি এবং হত্যা ও বিস্ফোরক আইন ও হত্যার ঘটনায় কুমিল্লায় আরও দুটি মামলা রয়েছে।
যেভাবে শিলংয়ে সালাউদ্দিন:
২০১৫ সালে উত্তরার একটি ভবন থেকে ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী’ পরিচয়ে একদল অস্ত্রধারী তাকে ‘অপহরণ’ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় সালাউদ্দিনকে। নিখোঁজের দুই মাস পর ১২ মে মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ের একটি রাস্তা থেকে মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় পুলিশ। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলা হয়। এরপর থেকে তিনি শিলংয়েই অবস্থান করছেন।