চট্টগ্রাম

কর্ণফুলীতে করোনায় মৃত ব্যক্তির আপনজন গাউছিয়া কমিটি —

 

রুপন দত্ত – আনোয়ারা প্রতিনিধি

লাশ পড়ে আছে ঘরের এক কোনায়। পাশে কেউ নেই, বাচ্চাদের নিয়ে মহিলারা সরে গেছে অনেক আগে। করোনায় মৃতের খবর শুনে স্বজনরাও আসছেনা, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে ৩ ঘন্টা আগে এখনও গোশল দেয়া হয়নি। মুঠো ফোনে খবর দেয়া হল গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশ টিম কর্ণফুলীকে। দ্রুত একটি টিম পৌঁছালো ঐ বাড়িতে, কিন্তু লাশ কোথায়! দুর থেকে এক স্বজন দেখিয়ে দিল লাশ ওই ঘরে। শুরু হল গোশল আর দাফনের কাজ। এভাবে করোনা মহামারির শুরু থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় ঘুরে-ঘুরে করোনায় মৃত ব্যক্তির দাফন-সৎকার এবং বেওয়ারিশ লাশ দাফন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার মুহাম্মদ ইমতিয়াজ উদ্দিনের নেতৃত্বে গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশ কর্ণফুলী টিম নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ২৫ জনের একটি দল।

মুসলিম হয়েও তাদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন করোনা উপসর্গে মারা যাওয়া হিন্দু,বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজনের লাশও। তারা করোনা আক্রান্ত বা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া নারী-পুরুষের দাফন-সৎকার করে যাচ্ছেন নিয়মিত। ডেলিভারি ও মুমুর্ষু রোগীকে দেওয়া হয়েছে এ্যাম্বোলেন্স সেবা। প্রতি দিনই বাড়ছে এ সংখ্যা। মহামারীতে প্রাণ হারানো এসব হতভাগার শেষ যাত্রার সঙ্গী হচ্ছেন এ স্বেচ্ছাসেবকরাই । রয়েছে ১১ সদস্যের একটি মহিলা দলও। কোন নারীর মৃত্যু ঘটলে কিংবা ডেলিভারি রোগীকে তাৎক্ষণিক এ্যাম্বোলেন্স সার্ভিস প্রদানে এই মহিলা দল এগিয়ে যায়।

করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি বা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশ মানুষের মনে ভয় তৈরি করছে। স্বজনেরাও ভয় পাচ্ছেন।

কর্ণফুলী টিম লিডার মোহাম্মদ ইমতিয়াজের সাথে কথা বলে জানা যায়,এমনো ঘটনাও ঘটেছে করোনা উপসর্গে এক মৃত ব্যক্তির ছেলে জানাজায় অংশ নিতে চাননি, অনেক মৃত ব্যক্তির স্বজনরা জানিয়ে দেন, তারা কোনো অবস্থাতেই হাসপাতালে আসবেন না। অনেক সময় কোনো স্বজনকেই পাওয়া যায়নি। মৃত ব্যক্তিকে হাসপাতাল থেকে স্বজন ছাড়া ছাড় করিয়ে নিতে কাগজপত্র তৈরি করতে দীর্ঘ সময় পিপিইসহ অন্যান্য পোশাক পরে হাসপাতালে বসে থাকা মানসিক যন্ত্রণাদায়ক হলেও সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে মৃত ব্যক্তিকে কবরে নামিয়ে দিয়ে দলের সবার পিপিইসহ অন্যান্য সুরক্ষা পোশাক আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে নিজেদের কার্যালয়ে ৬ থেকে ৭ ঘন্টা অবস্থান করার পর বাড়ি ফিরে।

শুধু মুসলিম নয় অন্যান্য ধর্মাবলম্বির দাফন-সৎকারেও এগিয়ে এসছেন কর্ণফুলী টিম, বোয়ালখালী উপজেলার এয়াকুবদন্ডী গ্রামের মহাজন বাড়ির নিরঞ্জন শীলের পুত্র বনমালী শীল দুবাইয়ে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। দেশে তার লাশ আসার পর স্বজন-প্রতিবেশীরা করোনা সংক্রমণের ভয়ে তাকে শেষ দেখাটুকুও কেউ দেখতে আসেননি। এমনকী আত্মীয়-স্বজনরাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন শোকাহত পরিবারটির কাছ থেকে। এ অবস্থায় সৎকার করতে শ্মশান পর্যন্ত কাঁধে করে নিয়ে যাওয়ারও যে কেউ না থাকায় চিন্তায় পড়ে বনমালী শীলের পরিবার। খবর পেয়ে গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশ চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টিমের প্রধান মুহাম্মদ ইমতিয়াজ উদ্দিন কর্ণফুলী থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে বোয়ালখালীতে এসে কাঁধে করে শ্মশান অবধি নিয়ে বনমালীর সৎকারের ব্যবস্থাও তারাই করলেন। কর্ণফুলী টিম লিডার মুহাম্মদ ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, ওইদিন আমার নানীও মারা যান। বনমালী শীলের লাশ সৎকার করে নানীর জানাজায় অংশগ্রহণ করি।

ইমতিয়াজ উদ্দিন নিজের অনুভুতি প্রকাশ করে বলেন, লাশের গোসল থেকে শুরু করে দাফনসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আমরা যখন ঘরে ফিরি, তখন নিজেরাই বুঝতে পারি না জীবিত আছি কি না। সুরক্ষা পোশাক পিপিই, হাতে গ্লাব্স, চোখে চশমাসহ পুরো পোশাক পরে কাজ করা যে কতটা কষ্টসাধ্য, তা বলে বোঝানো যাবে না। দমবন্ধ হয়ে আসে একেক সময়। এর পরও লাশ দাফনের পর মনে শান্তি পায়। তিনি আরো জানান,শিকলবাহ ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম,মহিউদ্দিন বকুল, ডাঃ মোহাম্মদ বেলাল, জি.এম মোহাম্মদ কবির, ওসমান গনী আকাশ, মাওলানা আহমদ হোসেন নিজামী, এডভোকেট জসিম উদ্দিনসহ অনেকেই তাদের এ যাত্রার সহযাত্রী। লাশ দাফনের জন্য মৃত ব্যক্তির জানাজার কাপড়, দাফনকারী ব্যক্তির জন্য একবার ব্যবহারযোগ্য সুরক্ষা সামগ্রীর খরচ তার প্রতিষ্ঠান তোহা এন্টারপ্রাইজ বহন করে। গড়ে একটি লাশ দাফন করতে আমাদের ১০-১২ হাজার টাকা খরচ হয়। গাউছিয়া কমিটির সদস্য ও কিছু শুভাকাঙ্খীদের আর্থিক সহযোগিতায় দাফনের কাজ হচ্ছে।

আনোয়ারা-কর্ণফুলী আসনের সাংসদ ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপি গাউছিয়া কমিটি কর্ণফুলী টিমকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেন,দেশের দুঃসময়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। রাজনীতি-ধর্ম সব কিছুর উর্ধে মানব সেবা, করোনা মহামারিতে দাফন-সৎকারে গাউছিয়া কমিটি কর্ণফুলী শাখার কার্যক্রমকে সাধুবাদ জানাই।

Related Posts