রুপন দত্ত – আনোয়ারা প্রতিনিধি
এক দশকে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির অঙ্ক বলছে কোথাও এক মিনিটও লোডশেডিং হওয়া উচিত নয়। আনোয়ারা উপজেলায় লোডশেডিং এখন প্রায় যেন নিত্যদিনের ঘটনা। প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। গত কিছুদিন যাবত লোডশেডিং এবং তীব্র দাবাদহ মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। শহর আর গ্রামের বৈষম্যের পাশাপাশি ইচ্ছাকৃত বিদ্যুৎ বন্ধ করে রাখার অভিযোগ রয়েছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বিরুদ্ধে। তবে পরিস্থিতি যাই হোক এত এত বিদ্যুৎ উৎপাদনের মধ্যেও লোডশেডিং নিয়ে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) কেউ মুখ খুলতে চান না।
আরইবি’র দায়িত্বশীলরা লোডশেডিং নিয়ে বলছেন, নিজেদের বিতরণ দুরবস্থার কারণেই বেশিরভাগ লোডশেডিং হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে গিয়ে দ্রুত সরবরাহ ব্যবস্থার বিস্তার ঘটানো হলেও মানের দিকে নজর রাখা হয়নি। এতে এখন এসে বিপত্তিতে পড়তে হচ্ছে। সরকার সারাদেশে ২০২১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এখন ৯৭ দশমিক পাঁচ ভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। কিন্তু সেই বিদ্যুৎ কতক্ষণ মানুষের বাড়ি থাকছে আর কতক্ষণ মানুষ বিদ্যুৎহীন কাটাচ্ছেন সেদিকে নজর দেওয়া হচ্ছে না।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ মনে করছেন, এখন মানুষকে নিরবচ্ছিন্ন মান সম্মত বিদ্যুৎ সরবরাহ করাই সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য আরও সময় প্রয়োজন বলে তিনি বিভিন্ন সময় বলে আসছেন।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (পিজিসিবি) এবং বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এর ওয়েবসাইট বলছে, দেশে যা বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে তার পুরোটাই সরবরাহ করা হচ্ছে। দুটি প্রতিষ্ঠানই বলছে লোডশেডিং শূন্য অর্থাৎ দেশের কোথাও লোডশেডিংই নাকি হয়নি। অনেক দিন আগে থেকেই জিরো লোডশেডিং আওয়ার হিসেবে তারা সব প্রতিবেদন তৈরি করছে। পিজিসিবির ওয়েবসাইট বলছে ১২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট সর্বোচ্চ চাহিদার বিপরীতে দেশে ১৫ হাজার ১০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। এতে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে তারা বলছে রিজার্ভ পাওয়ার প্ল্যান্ট। অর্থাৎ এই পরিমাণ পাওয়ার প্ল্যান্ট না চালালেও বিদ্যুতের সংকট হওয়ার কথা নয়। এর ঠিক আগের দিনের চিত্রও একইরকম। সে দিনও তিন হাজার ২৬ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র রিজার্ভ পাওয়ার প্ল্যান্ট ছিল। এ তথ্য সঠিক হলে দেশের কোথাও লোডশেডিং হওয়ার কথা নয়। সারাদেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫২ থেকে ৫৭ ভাগ সরবরাহ করে আরইবি। পিডিবি বলছে দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা (গ্রিড সংযুক্ত) ১৯ হাজার ৮৯২ মেগাওয়াট।
আনোয়ারা সদরের বাসিন্দা স্কুল শিক্ষক টিসু কুমার শীল বলছেন, বিদ্যুৎ যেতেই থাকে। দিনের মধ্যে ৫ থেকে ৬ বার বিদ্যুৎ যায়। গেলে কখন আসবে তা কেউ জানে না। আকাশে মেঘ হলেও অনেক সময় বিদ্যুৎ চলে যায়। কখনও ১৫ মিনিট আবার কখনও এক ঘণ্টা। সন্ধ্যায় আযান দিলো আর বিদ্যুৎ নাই। এলো হয়তো অনেক রাতে। এইভাবেই চলছি । উপজেলা সদরে কথা হয় মো. সাইফুদ্দিনের সাথে , তিনি জানান, দিনের মধ্যে কমপক্ষে ছয় সাত বার বার বিদ্যুৎ যায়। প্রতিদিনই একই ঘটনা। আর বিদ্যুৎ কখন যাবে কখন আসবে তার ঠিক নেই। ফলে, দোকান চালানো, বাচ্চাদের পড়ালেখা সব কিছুতেই সমস্যা হয়। তারপরও আমরা মানিয়ে নিয়ে চলি। একই ধরনের অভিযোগ করেছেন চাতুরী চৌমুহনী বাজারের এক ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, লোডশেডিং হতেই থাকে। আমরা মাঝে মাঝে স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিসে ফোন দিলে তারা নানা রকম অজুহাত দিতে থাকে। অনেক সময় সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ গিয়ে সারারাত আসলোই না। কারও কোনও মাথা ব্যথা নেই। আমাদের মতো সাধারণ মানুষই শুধু ভোগান্তির শিকার হয়।
অর্থাৎ পিডিবি এবং পিজিসিবি যাই বলুক না কেন লোডশেডিং রয়েই গেছে। আবার যদি কেউ মনে করেন গ্রাহক লোডশেডিং-এর ভুল তথ্য দিচ্ছে সেক্ষেত্রে আরইবির প্রতিদিনের বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রতিবেদনে কি বলছে একটু জেনে নেওয়া যাক। ২৩ মে ভোর ৪টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত আরইবি যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে এতে দেখা যায় সন্ধ্যা ৭টায় আরইবির মোট বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৬ হাজার ৭৪২ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে সরবরাহ পেয়েছে ৬৫৩৮ মেগাওয়াট। অর্থাৎ চাহিদার ২৬ ভাগ বিদ্যুৎ পায়নি আরইবি। আরইবির সারা দিনব্যাপী এই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ভোর ৪টায় চাহিদার ৬ ভাগ, সকাল ৭টায় ৭ ভাগ, সকাল ১০টায় ৭ ভাগ, দুপুর ১টায় ৬ ভাগ, বিকেল ৫টায় ৪ ভাগ, রাত ৮টায় ৬ ভাগ, রাত নটায় ৭ ভাগ এবং রাত ১১ টা অর্থাৎ অফপিক যখন চাহিদা থাকে না তখনও ৬ ভাগ বিদ্যুৎ প্রাপ্তিতে ঘাটতি ছিল। অর্থাৎ শুধু যে পিক আওয়ার বা সর্বোচ্চ চাহিদার সময়ই ঘাটতি থাকে তা নয়, অফপিকেও সরবরাহ ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
আরইবির শীর্ষ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সন্ধ্যায় যদি বিদ্যুৎ যায় তা সাধারণত যে পরিমাণ বিদ্যুৎ দরকার তা পাই না বলে। আর দিনের বেলা অনেক সময় আমরা আপগ্রেডেশন করি।
পল্লী বিদ্যুৎ এর এক কর্মকর্তা বলেন, ইদানিং বিদ্যুৎ বন্ধ করে রাখার প্রধান কারণ ঝড় বৃষ্টি। আইবির বেশিরভাগ লাইনই গ্রামের ঘরবাড়ি এবং গাছের ওপর দিয়ে নির্মিত। আকাশে মেঘ দেখা দিলেই এসব লাইন বন্ধ করে রাখা হয়। তিনি আরো বলেন, আরইবির লাইন আগে ছিল দুই লাখ কিলোমিটার, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৫ লাখ কিলোমিটার। সিস্টেম অনেক বড় হয়েছে। বিদ্যুৎ বরাদ্দ কম দেওয়া ছাড়াও বিতরণ এবং সঞ্চালন লাইনের কারণেও অনেক সময় লোডশেডিং হয়।