নিজের মেয়াদকালে সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে হস্তক্ষেপ করতে না দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, সেনাপ্রধান হিসেবে নিজের মেয়াদকালে আমি রাজনীতিতে নাক গলাব না। আমি সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে হস্তক্ষেপ করতে দেব না। এটাই আমার স্পষ্ট অঙ্গীকার।
সেনাপ্রধান বলেন, আমরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, রাজনীতিবিদের বিকল্প রাজনীতিবিদরাই। তাদের বিকল্প সেনাবাহিনী নয়।
সেনা সদর দপ্তরে সম্প্রতি একটি সংবাদমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন অঙ্গীকারের কথা জানান তিনি। সাক্ষাৎকারটি বুধবার (১ জানুয়ারি) প্রকাশিত হয়েছে।
সাক্ষাৎকারে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী দেশের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা, অন্তর্বর্তী সরকারকে সেনাবাহিনীর সমর্থন, নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক, সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানের ক্ষমতার ভারাসাম্যসহ বেশ কিছু বিষয়ে সেনাপ্রধানের ভাবনার কথা উঠে আসে।
যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করে অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থাকার কথা জানিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে সহায়তা করছি। তারা আমাদের কাছ থেকে যে ধরনের সহায়তা চাইছে, সেভাবেই সহায়তা দিচ্ছি এবং দেব। যেদিন অন্তর্বর্তী সরকার বলবে, আপনাদের অনেক ধন্যবাদ, আপনারা আপনাদের কাজটা সম্পন্ন করেছেন, এখন পুলিশ আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব নেবে। আমরা তখন সানন্দে সেনানিবাসে ফিরে যাব।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীর দীর্ঘদিন মাঠে থাকার ঝুঁকির বিষয়ে সেনাপ্রধান বলেন, আমরা আইনশৃঙ্খলার দেখভাল করছি। কিন্তু আমাদের ১/১১–এর অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। সেনা সদস্যদের মাঠে দীর্ঘদিনের উপস্থিতি উচ্ছৃঙ্খল কাজে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি করে। যদিও সংখ্যাটা খুবই কম। শৃঙ্খলাজনিত ঘটনার জন্য আমরা সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত শেষে শাস্তিও দিই। এরপরও শৃঙ্খলাভঙ্গের বিষয়টি আমাদের জন্য বিব্রতকর। আমাদের তো এ ধরনের কাজে যুক্ততা কিংবা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার জন্য তৈরি করা হয়নি।
নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরির গুরুত্ব দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আমি আশাবাদী। রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে ভালো রাজনীতিবিদ রয়েছেন। হয়তো ভিন্নমতের মানুষও আছেন। আমার অতীত অভিজ্ঞতায় বলে, যখন এমন একটা ক্রান্তিকাল আসে, আমাদের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বসলে তারা সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসেন।
অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার বিষয়ে সেনাপ্রধান বলেন, এখন সমঝোতা সম্ভব। একসঙ্গে বসে এটা করা সম্ভব। এটা একটা সংস্কৃতির ব্যাপারও বটে। সবার এটা বোঝা উচিত। আমি নৈরাশ্যবাদী নই।
সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনার ব্যাপারেও কথা বলেন সেনাপ্রধান। সশস্ত্রবাহিনীকে রাষ্ট্রপতির অধীনে রাখার ব্যাপারে নিজের মনোভাবের কথাও জানান তিনি।
এ ব্যাপারে ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, আমি সংবিধান বিশেষজ্ঞ নই। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকেই বুঝেছি, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা প্রয়োজন। সশস্ত্র বাহিনীকে রাষ্ট্রপতির অধীন রাখা যেতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সশস্ত্র বাহিনী প্রধান উপদেষ্টার অধীন ছিল। আমি এই ধারণার কথা বলছি। ক্ষমতার ভারসাম্য আনার প্রসঙ্গটি নিয়ে ভাবছি। কীভাবে সেটা হতে পারে, বিশেষজ্ঞরা বললেই ভালো। কিন্তু এই পরিবর্তন আনতে পারলে শাসনব্যবস্থায় একটা ভারসাম্য আসবে।
নতুন বছরের প্রত্যাশা নিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, ২০২৫ সালে আমরা একটা দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পথে যেতে চাই। সে জন্য সবাইকে একসঙ্গে চলতে হবে। সবাইকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকতে পারে; কিন্তু জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্য জরুরি। তাহলেই গণতন্ত্র স্থায়ী হবে।
আমরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চাই। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য এখন শান্তি ও স্থিতিশীলতা খুবই জরুরি। এই দুটি বিষয় না হলে উন্নয়ন আর সুশাসনও আসবে না। সে জন্য আমাদের মধ্যে সহিষ্ণুতা ফিরিয়ে আনতে হবে। সে জন্য একটা জাতীয় সমঝোতার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।