নিউজ ডেস্ক:
কেটে গেছে করোনা টিকার ভয়। উদ্বোধনের দিন থেকে টিকা গ্রহণে ফিরেছে আস্থা। গুজব আর বিভ্রান্তিকর তথ্যের হয়েছে পরাজয়। গতকাল ৪০০ থেকে ৫০০ মানুষের টিকা গ্রহণের কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি মানুষ টিকা গ্রহণ করেছে।
মন্ত্রিপরিষদ সদস্য থেকে সরকারের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা, চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রায় সাড়ে ৫০০ মানুষ রাজধানীর পাঁচ হাসপাতালে স্বতঃস্ফূর্তভাবে টিকা গ্রহণ করেছেন। তাদের মধ্যে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের অ্যানেস্থেশিয়া অ্যান্ড আইসিইউ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. চন্দন কুমার বণিক টিকা গ্রহণের পর কিছুটা অস্বস্তিবোধ করলেও ক্ষাণিকবাদে সুস্থ হয়ে উঠেন। এছাড়া বাকি টিকাগ্রহীতারা সুস্থতার সাথেই বাড়ি ফিরেছে।
একদিনে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীনভাবে এত সংখ্যক ব্যক্তিকে টিকা গ্রহণ করতে দেখে জনমনে আস্থা ফিরে এসেছে। রাজধানীর বিভিন্ন পেশার বেশ কয়েকজন মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, তারা এখন জাতীয়ভাবে টিকা গ্রয়োগের অপেক্ষায় রয়েছেন। নির্দিষ্ট তথ্যপূরণ করে টিকা গ্রহণে জনমনে আগ্রহ বেড়েছে। রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় বেসরকারি একটি ব্যাংকে কর্মরত মো. ইফতেখার আমিন বলেন, টিকা নিয়ে মনে একটা ভীতি কাজ করছিল। সরকারের হেভিওয়েটদের টিকা নিতে দেখে আমি নিজেও টিকা গ্রহণে আগ্রহী হয়েছি। ইতোমধ্যে সুরক্ষা অ্যাপে নিবন্ধনও করেছি। আগামী মাসে জাতীয়ভাবে টিকা গ্রয়োগ শুরু হলে আমিও টিকা নিতে আগ্রহী। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সাধারণ নাগরিকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে সরকার সবাইকে বিনামূল্যে টিকা প্রয়োগে প্রস্তুত। মন্ত্রী-আমলারা টিকা গ্রহণের মধ্যদিয়ে প্রমাণ হয়েছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড টিকা ক্ষতিকারক নয়। একটি মানসম্মত করোনার প্রতিষেধক।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, দ্বিতীয় দিনেও সফলভাবে টিকাদানের কর্মসূচি সমাপ্তি হয়েছে। রাজধানীর পাঁচটি হাসপাতালে দ্বিতীয় দিনে মোট ৫৪১ জনকে টিকা দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে ৪৩১ জন পুরুষ ও ১১০ জন নারী। তাছাড়া ভিআইপি পাঁচজন, চিকিৎসক ৩৯৬ জন, নার্স ৩২ জন। তার মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১২০ জনকে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮ জনকে, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ১০০ জনকে, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ৫৮ জনকে এবং মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৬৫ জনকে টিকা দেয়া হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়ার টিকা গ্রহণের মধ্যদিয়ে হাসপাতালটিতে টিকা গ্রহণ শুরু হয়। এরপর তিন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. রফিকুল আলম (প্রশাসন), অধ্যাপক ডা. শাহানা আক্তার (শিক্ষা), অধ্যাপক ডা. জাহিদ হোসেন (গবেষণা), কোষাধ্যক্ষ মো. আতিকুর রহমান এবং হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুলফিকার আহমেদ আমিনও করোনা টিকা গ্রহণ করেন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে লম্বা হয় টিকা গ্রহীতার তালিকা। সকাল ১০টার কিছুক্ষণ পর বিএসএমএমইউতে টিকা গ্রহণ করেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তারপর টিকা নেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান, সস্ত্রীক টিকা গ্রহণ করেন তথ্য সচিব খাজা মিয়া। (তার সঙ্গে তার স্ত্রী সরকারের অতিরিক্ত সচিব খালেদা আক্তারও টিকা গ্রহণ করেন)। অন্যদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদও টিকা গ্রহণ করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, দেশের জনগণের মন থেকে বিভিন্ন বিভ্রান্তি দূর করার লক্ষ্য নিয়েই প্রথম টিকা নিয়েছি। এর মাধ্যমে আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। এটা করতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। টিকা নেয়াটা আমার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। আমাকে দেখে মানুষ আস্থা পাবে, সাহস পাবে। টিকা নিয়ে মানুষের মনে সংশয় ছিলো। এটা কেটে যেতে শুরু করেছে। এটাই আমার লক্ষ্য ও প্রত্যাশা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক (হাসপাতাল) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. জুলফিকার আহমেদ আমিন বলেন, খুবই ভালো আছি। কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। দেশের যুগান্তকারী অধ্যায়ে আমি একজন মুখপাত্র হওয়ার সুযোগ পেয়েছি।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল মান্নান বলেন, সরকারের প্রতি মানুষের ভরসা, আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ যেনো আরও বাড়ে এজন্যই টিকা নেয়া। টিকার ওপর মানুষের ভরসা বাড়াতেই সবার সামনে টিকা নিয়েছি। টিকা নেয়ার পর কোনোরকম অস্বাভাবিকতা বোধ করছি না। আমার কাছে মনে হচ্ছে আগে যা ছিলাম এখনো তাই আছি। টিকা গ্রহণের ২০ মিনিটের মধ্যেই আমি আমার স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করেছি। আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ আছি। গুজবে কান না দিয়ে সকলকে টিকা গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি বলেন, আমরা উৎসবমুখর পরিবেশে এই কাজটা করতে পেরেছি, এটি আমাদের একটি সফলতা। যারা টিকা গ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে অনেকেই সেলিব্রেটি। এর মধ্যে সরকারের মন্ত্রী, সচিবসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। স্বপ্রণোদিতভাবে যারাই টিকাপ্রাপ্তির রেজিস্ট্রেশন করবে তাদের প্রত্যেককে সরকার বিনামূল্যে টিকা দেবে।
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে টিকা গ্রহণ করেছি। ভালো লাগছে। তবে বিশেষ কিছু অনুভব করছি না। এটি অন্য সাধারণ টিকার মতোই। সাধারণ মানুষ বুঝুক এটি একটি নিরাপদ টিকা।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, টিকা নিয়ে সোস্যাল মিডিয়ায় অপপ্রচার চলছে। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে, সংসদ সদস্য হিসেবে আমি প্রথম টিকা গ্রহণ করে যারা সমালোচনা করছে তাদের জবাব দিলাম। টিকা কার্যক্রম সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালিত হচ্ছে। কেউ যেনো মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে বিভ্রান্তি তৈরি না করে সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। মন্ত্রিপরিষদ সদস্য হিসেবে টিকা গ্রহণ করে সবাইকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করেছি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক রাজধানীর পাঁচ হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে বলেন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিড-১৯ টিকা সবচেয়ে নিরাপদ। এই টিকায় কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। আপনারা নির্ভয়ে টিকা নেন। টিকা পরবর্তী যা করণীয় তা করা হবে। আপনারা ভয় পাবেন না। ইতোমধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সদস্য ও সচিবরা টিকা নিয়েছেন। এ পর্যন্ত যারা টিকা নিয়েছেন, তারা সকলেই ভালো আছেন। এখন পর্যন্ত তাদের কোনো ধরনের অসুবিধা বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। আমি এর আগেও বলেছি এই টিকা খুবই ভালো টিকা এবং আন্তর্জাতিক মানের একটি টিকা।
টিকা গ্রহণ উপলক্ষে দেশে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, টিকা নিয়ে সরকার-দেশবাসী সকলেই আনন্দিত। টিকা কার্যক্রম অনুষ্ঠানে সকলের মধ্যে ঈদের মতো আনন্দ উৎসব বিরাজ করছে। ঈদ আনন্দে টিকা কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতিটা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও টিকা সেন্টারে এই আনন্দঘন পরিবেশে টিকা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।