নিউজ ডেস্ক:
নানা ধরনের উদ্ভট গুজব আর বিরোধী শিবিরগুলোর বিরোধিতা উপক্ষো করে করোনা টিকা কার্যক্রমে সফলতা পেয়েছে সরকার। বৈশ্বিক মহামারি করোনা মোকাবিলায় বিনামূল্যে সরকারি ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রম নিয়ে সমালোচনা উপক্ষো করে জনগণের সাড়া মিলেছে। গত সাতদিন করোনার টিকা নিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ীই এগোচ্ছে টিকাদান কার্যক্রম। এর মাধ্যমে টিকা নিয়ে সরকারবিরোধী মিশন ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তীব্র সমালোচনার মুখে গত ২১ জানুয়ারি প্রতিবেশী দেশ ভারতের দেয়া উপহার হিসেবে কোভিশিল্ড নামের ২০ লাখ টিকা গ্রহণ করে বাংলাদেশ। এর চারদিন পর ২৫ জানুয়ারি ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা তিন কোটি ডোজ করোনা টিকার প্রথম চালানের ৫০ লাখ ডোজ আসে। এরপর ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে করোনা টিকা প্রয়োগ শুরু করে বাংলাদেশ। টিকাদান কার্যক্রম উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ওইদিন প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তাকে প্রথম টিকা দেয়া হয়। প্রথম দিন রুনু কস্তার সঙ্গে একই হাসপাতালের দুজন সিনিয়র স্টাফ নার্স মুন্নী খাতুন ও রিনা সরকারও টিকা নেন। এদিন আরও টিকা নেন ডা. আহমেদ লুৎফুল মবিন, চিকিৎসক কুর্মিটোলা; অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা, অতিরিক্ত মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর; দিদারুল ইসলাম, ট্রাফিক মতিঝিল বিভাগ; ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম ইমরান হামিদ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। প্রধম ধাপের টিকা কার্যক্রম উদ্বোধনের পর সাতদিন পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। এমন অবস্থায় সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সারা দেশে মানুষের সুরক্ষার জন্য কোভিড-১৯ টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথম দিনে জনপ্রতিনিধি, সম্মুখসারির যোদ্ধা এবং প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা করোনার টিকা নেন।
সর্বশেষ তথ্য মতে, এ কার্যক্রমের উদ্বোধন হওয়ার পর থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত সাত লাখ ৩৬ হাজার ৬৮০ জন মানুষ করোনার টিকার প্রথম ডোজ গ্রহণ করেন। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরীতে টিকা নিয়েছেন ৯৫ হাজার ৪৬৫ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে টিকা নিয়েছেন এক লাখ ৯৪ হাজার ৩৭১ জন। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরীতে ২৪ ঘণ্টায় টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ২৬ হাজার ৫৬৪ জন। রাজধানীসহ সারা দেশের এক হাজার পাঁচটি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দুই হাজার ৪০০ বুথে টিকা প্রদান করা হচ্ছে।
সূত্র মতে, বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস গত বছরের মার্চে বাংলাদেশে আঘাত করে। ভাইরাসটি আঘাতের পর থেকে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত প্রায় সোয়া পাঁচ লাখ মানুষ সংক্রমিত হয়েছে এবং মৃত্যুবরণ করেছেন আট সহস্রাধিক। এ অবস্থায় শুরু থেকেই চরম অস্বস্তি ও ঝুঁকি রয়েছে বয়স্ক, শিশু ও বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা। এ পরিস্থিতির মধ্যেই প্রতিবেশী দেশ ভারত বাংলাদেশকে কোভিশিল্ড নামের ২০ লাখ টিকা উপহার দেয়ার ঘোষণা দেয়। সে সময় দেশজুড়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ে ভ্যাকসিনের কারণে মানুষকে ‘যৌন-অক্ষম’ বানিয়ে দেবে, ভারতের কোভিড টিকায় শূকরের মাংস আছে, টিকার ভেতরে মাইক্রোচিপ আছে, টিকা ডিএনএ বদলে দেয়াসহ নানামুখী প্রচার-প্রচারণা করা হয়।
বিশেষ করে সরকার ও ভারত থেকে আসা ভ্যাকসিনের বিরোধিতা করে বিএনপি-জামায়াতসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনপির শীর্ষ নেতারাও নিজ নিজ দলের সভা-সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলন ও টেলিভিশনের টকশোগুলোতে নানামুখী অপ্রপ্রচার করেন। সরকারবিরোধী সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা নানা অভিযোগ করেন। অনেকেই মন্তব্য করেন, বাংলাদেশের মানুষ ভারতের গবেষণাগারের ‘ব্যাং, বিড়াল, তেলাপোকায়’ পরিণত হয়েছে। ভারত তিস্তার পানি তো দেয় না, কিন্তু উপহার হিসেবে ২০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন দিলো। এই দরদ উতলে ওঠার কারণ কী? ভারত মূলত বাংলাদেশের মানুষের ওপর ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চালাতে চায়। বাংলাদেশের সরকার ভারতকে সেই সুযোগ করে দিয়েছে। করোনার ভ্যাকসিন সরকারের বিপজ্জনক ও সর্বনাশা খেলা। ভারতের ভ্যাকসিন সরকারের নয়া কৌশল। বিরোধীদের কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সবার আগে টিকা নেয়ার পরামর্শ দেন। টিকা নিয়ে এমন গুজব মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। টিকা গ্রহণে অনাস্থা দেখা দেয় সাধারণ মানুষের মাঝে। যা সরকার প্রধানের সামনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়। তবে গুজব, ষড়যন্ত্র ও সমালোচনার মুখে টিকা প্রয়োগে অনড় ছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সব সমালোচনার জবাব দিয়ে গত ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে টিকা প্রয়োগের কার্যক্রম শুরু করেন তিনি। প্রথমে টিকায় মানুষের আস্থায় সংকট থাকলেও এখন প্রতিটি মানুষ টিকা গ্রহণ করছেন। সমালোচনাকারীরাও টিকা গ্রহণ করেছেন ইতোমধ্যে। মানুষের আস্থা বাড়াতে টিকা গ্রহণ করেছেন সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, শীর্ষ কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন বিষয়েও অনেক সমালোচনা করা হয়েছে। অনেকে বলেছেন ভ্যাকসিন আসবেই না বাংলাদেশে, ভ্যাকসিন এলেও কার্যকর হবে না। যারা করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন, তারাই এখন সবার আগে ভ্যাকসিন নিচ্ছেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, সকল সমালোচনা এবং ভীতি উপেক্ষা করেই করোনা ভ্যাকসিন গ্রহণে ফিরেছে মানুষ। উৎসবমুখর পরিবেশে টিকা নিচ্ছেন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। ইতোমধ্যে স্বপ্রণোদিত হয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রায় ১২ লাখেরও বেশি মানুষ টিকার জন্য সরকারের সুরক্ষা ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করেছে। সেই সাথে সাত দিনে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষাধিক মানুষ টিকা গ্রহণ করেছেন। টিকায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা না যাওয়ায় দিনে দিনে টিকাগ্রহীতাদের আগ্রহ বাড়ছে। ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, সাংসদ, প্রধান বিচারপতি, সচিবসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা টিকা গ্রহণ করেছেন। আগামী সাত দিনের মধ্যে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের টিকা গ্রহণের জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। বাদ পড়েনি সুশীলসমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষও। এতে করোনার টিকা বিষয়ে বিভ্রান্তি কাটতে শুরু করেছে। করোনার টিকা বিষয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ থেকে বোঝা যাচ্ছে, করোনার টিকা প্রয়োগ বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনাও সফলভাবে বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু দুই সপ্তাহ আগেও পরিস্থিতি ছিলো ভিন্ন। মানুষ টিকা গ্রহণে চরমভাবে অনাগ্রহ দেখায়।
টিকাদান কর্মসূচিতে অংশ নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে দেশের বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো। ইতোমধ্যে তারা টিকা আমদানি, সংরক্ষণ ও সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধনী ও সক্ষম ব্যক্তিদের অর্থের বিনিময়ে টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনা করতে চায়। সরকার গর্ভবতী নারী ও শিশু ব্যতিত দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ, অর্থাৎ ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০৮ জন মানুষকে করোনা ভাইরাসের টিকা দেয়ার পরিকল্পনা করেছে। প্রতিজনকে দেয়া হবে দুই ডোজ টিকা।
সুরক্ষা অ্যাপ এবং ওয়েবসাইটে জানতে পারছেন করোনা ভ্যাকসিন নিবন্ধন করতে জাতীয় পরিচয়পত্র এবং নাম-ঠিকানা, বয়স, পেশা, শারীরিক পরিস্থিতি, ফোন নাম্বার ইত্যাদি তথ্য দিতে হবে। নিবন্ধন সম্পন্ন হলে মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে ভ্যাকসিনের তারিখ ও কেন্দ্র জানিয়ে দেয়া হয়। অথবা ভোটার আইডি কার্ড নিয়ে কেন্দ্রে গেলে নিবন্ধন করা যাবে। নিবন্ধনের ভিত্তিতে কেউ টিকা দেয়ার পর তাকে একটি কার্ডে পরবর্তী ডোজের সময় ও তারিখ লিখে দেয়া হবে। প্রথমটি নেয়ার চার থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ নিতে হবে। চলতি মাসে ৩৫ লাখ টিকা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। কারণ এই টিকার দুটি করে ডোজ দিতে হয়। তাই ৩৫ লাখ মানুষকে যেনো সম্পূর্ণ টিকা কর্মসূচির আওতায় আনা যায়। সরকারের টার্গেট পূরণ হয়ে আরও বেশি মানুষ টিকা নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, দিনে দিনে টিকা গ্রহীতার সংখ্যা বেড়েছে। টিকা নিয়ে বিভিন্ন কথাবার্তা হয়েছিল, সব কিছুকে তোয়াক্কা না করে টিকা কার্যক্রম এগিয়ে যাচ্ছে। যারা সমালোচনা করেছিল, তারাও আগে আগে টিকা নিয়ে নিচ্ছে। আমাদের অনলাইন নিবন্ধনের চেয়ে অনস্পট নিবন্ধনের সংখ্যা বেড়েছে।
দেশব্যাপী করোনার টিকা প্রয়োগ কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকেই জনগণ রেজিস্ট্রেশন করার মাধ্যমে অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে টিকা গ্রহণ করতে শুরু করেছে। টিকার গুজব নিয়ে প্রথমে কিছুটা আতঙ্ক থাকলেও বর্তমানে সাধারণ মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরেছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগ বলছে, করোনার টিকা নিয়ে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো প্রথম থেকেই মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন গুজব তৈরি করে দেশ ও দেশের মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্ব ও সঠিক সিদ্ধান্তের কারণে সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে জেলা-উপজেলাপর্যায়ের সকল শ্রেণির মানুষ করোনার টিকা গ্রহণ করছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, করোনা ভাইরাসের টিকা নিয়ে সব ‘অপপ্রচার ও গুজব’ ব্যর্থ হয়েছে। জনগণ অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করার মাধ্যমে টিকা গ্রহণ করছে। যারা সংশয় সৃষ্টি করার জন্য টিকা নিয়ে ‘অপপ্রচার ও গুজব’ ছড়ায়, তাদের সকল অপচেষ্টা আবারো ব্যর্থ হয়েছে।
করোনা নিয়ে যারা গুজব ও অপপ্রচার ছড়িয়েছে, তাদের মুখে ছাই পড়েছে দাবি করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম আমার সংবাদকে বলেন, করোনার শুরু থেকে সরকারবিরোধীরা নানামুখী অপপ্রচার ও গুজব ছড়িয়ে আসছে। দেশে ভ্যাকসিন আসা ও প্রয়োগ নিয়েও তারা মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট অপপ্রচার চালিয়েছেন। কিন্তু দেশের সকল শ্রেণির মানুষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর আস্থাশীল। তারা গুজবে কান না দিয়ে ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন। ফলে ভ্যাকসিন নিয়ে যারা মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়েছেন, তাদের মুখে ছাই পড়েছে।