অপরাধ জাতীয়

সেই মুক্তিযোদ্ধার পরিবার ‘আতঙ্কে’ এলাকাছাড়া, গ্রেপ্তার নেই

 

নিজস্ব প্রতিবেদক
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই কানুর গলায় জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত করার পর ‘নিরাপত্তাহীনতা ও আতঙ্কে’ এলাকা ছেড়ে গেছে তার পরিবার।
এ ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার জন্য প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে নির্দেশ দেওয়া হলেও সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
যদিও জড়িতদের গ্রেপ্তারে ‘কাজ করার’ কথা বলেছেন চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি এ টি এম আক্তার উজ জামান।
রোববার আবদুল হাই কানুর গলায় জুতার মালা পরিয়ে তাকে সারা গ্রাম ঘুরিয়ে লাঞ্ছিত করে একদল লোক। তারা ওই ঘটনার ভিডিও ধারণ করে। সন্ধ্যার পর ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়।
এক মিনিট ৪৭ সেকেন্ডের সেই ভিডিওতে দেখা যায়, দুই ব্যক্তি জুতার মালা পরা অবস্থায় কানুকে টানাহেঁচড়া করছেন। এ সময় কানু বারবার তাকে ছেড়ে দেওয়ার আকুতি জানাচ্ছিলেন।
যিনি ভিডিও করছিলেন তিনি ওই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বলছিলেন, “আপনি পুরো গ্রামের মানুষের কাছে মাফ চাইতে পারবেন?” তখন ওই বীর মুক্তিযোদ্ধা দুই হাত তুলে বলেন, “আমি মাফ চাই।”
যে দুজন ওই মুক্তিযোদ্ধার দুই হাত ধরে টানাহেঁচড়া করছিলেন তাদের একজন বলেন, “আপনি এলাকা থেকে কবে চলে যাবেন?”
লাঞ্ছনাকারীরা বারবার ওই মুক্তিযোদ্ধাকে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হুমকি দিতে থাকেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা বারবার লাঞ্ছিতকারীদের হাতে ধরে এলাকায় নিজ বাড়িতে থাকার আকুতি জানান।
কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আবদুল হাই কানু সংগঠনের কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা কমিটির সাবেক সহসভাপতি। তিনি ঘটনাস্থলের পাশের লুদিয়ারা গ্রামের বাসিন্দা।
এ ঘটনার জন্য মুক্তিযোদ্ধা কানুর পরিবার স্থানীয় জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদের দায়ী করলেও দলটি নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছে।
মুক্তিযোদ্ধার ছেলে গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া বিপ্লব সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, ওই ঘটনার পর তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাকে ফেনীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আর নিরাপত্তাহীনতার কারণে পরিবারও গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে।
বিপ্লব বলেন, “কুলিয়ারা গ্রামের আব্দুল বারিকের ছেলে জামায়াত সমর্থক আবুল হাশেম মজুমদারের নেতৃত্বে আমার বাবাকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। ওখানে যারা ছিল সবাই জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী।
“আমার বাবা অপমান সইতে না পেরে অসুস্থ হয়ে যান। ফেনীর একটা হাসপাতালে ভর্তি আছেন। আমাদের এলাকায় থাকা নিরাপদ নয়, বারবার আমাকে বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। পরিবার নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় এলাকার বাইরে আছি।”
আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে মুক্তিযোদ্ধা কানু দীর্ঘদিন এলাকায় থাকতে পারেননি বলে তার পরিবারের অভিযোগ। সরকার পতনের পর তিনি কয়েকদিন আগে বাড়ি আসেন।
বিপ্লব বলেন, “আওয়ামী লীগের আমলেও আমার বাবা বাড়িতে ঘুমাতে পারেননি। কয়েকদিন হল বাড়িতে এসেছেন। বাবার শরীর অসুস্থ। গতকাল ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছিলেন পাশের বাজারে। পথের মধ্যে আটকে আমার বাবাকে জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত করা হল। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকেও তারা ছাড়েনি।”
এ ঘটনায় এখনো কোনো মামলা বা লিখিত অভিযোগ করা হয়নি বলে জানান কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) আরাফাতুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “আমরা লিখিত কোনো অভিযোগ পাইনি, তবে আমরা মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তিনি অসুস্থ, ফেনীতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। যারা এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে… আমাদের টিম রাত থেকে এখন পর্যন্ত মাঠে আছে, গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।”
জামায়াতের নিন্দা, সম্পৃক্ততা অস্বীকারঃ
মুক্তিযোদ্ধাকে লাঞ্ছিতের ঘটনায় চৌদ্দগ্রাম উপজেলা জামায়াতে ইসলামী নিন্দা জানিয়েছে। উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি মু. বেলাল হোসাইন বলেন, ‘স্থানীয় কুচক্রি মহল’ তার দলকে জড়িয়ে ‘অপপ্রচারে’ লিপ্ত হচ্ছে।
জামায়াতের কেউ এ ঘটনার সঙ্গে ‘জড়িত না’ দাবি করে তিনি বলেন, “যে ব্যক্তিদ্বয় আবদুল হাই কানুকে লাঞ্ছিত করেছেন- তাদেরকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি নানাভাবে অত্যাচার নির্যাতন ও মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছেন। এ ছাড়া আবদুল হাই কানুর নিজ দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার বিরোধ রয়েছে। এই বিরোধের জের ধরে বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিদ্বয় এই কাণ্ড ঘটিয়েছে।”
জামায়াত নেতা বলেন, আবু বক্কর ছিদ্দিক ওরফে রানা হত্যা মামলার আসামি আবদুল হাই কানু। তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের করা একাধিক মামলা রয়েছে।

Related Posts