চট্টগ্রাম লিড নিউজ

ট্রেনের ইঞ্জিন কেনায় বড় দুর্নীতি !

নিজস্ব প্রতিবেদক
রেলের নিম্মমানের মিটারগেজ ইঞ্জিন আমদানি নিয়ে সাগরচুরির ঘটনা ঘটেছে। এখাতে প্রায় ৩২০ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে। এবার সেইসব দুর্নীতিবাজদের বাঁচাতে কলকাটি নাড়ছেন শীর্ষ কর্মকর্তারা। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়েছে। এনিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ৩২২ কোটি টাকায় কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানি ১০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন সরবরাহ করে রেলওয়েকে। এসব ইঞ্জিনে দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী যন্ত্রাংশ সংযোজন করা হয়নি। তৈরি করা হয়েছে মূলত নিম্নমানের যন্ত্রাংশ দিয়ে। প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন সনদ ছাড়াই গত আগস্ট মাসে সেসব পাঠানো হয় বাংলাদেশে।
কিন্তু চুক্তির শর্ত অনুসরণ করে ইঞ্জিনগুলো সরবরাহ না করায় প্রকল্প পরিচালক সেসব গ্রহণ করেননি। পরে ঊর্ধতন কর্মকর্তার নির্দেশে এগুলো জাহাজ থেকে নামিয়ে রাখা হয়। আর এর নেপথ্যে ছিলেন রেলওয়ে মহাপরিচালক (ডিজি) মো. শামছুজ্জামান, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) আরএস মো. মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী।
ইঞ্জিনগুলো কেনায় অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় গত ২৪ নভেম্বর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রায় দেড় মাস হতে চললেও এখন পর্যন্ত রিপোর্ট জমা হয়নি। উল্টো তদন্ত নিয়ে চলছে একের পর এক নাটক। অভিযোগ উঠেছে যে কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকেই করা হয়েছে কমিটির সদস্য।
জানা গেছে, ৩২২ কোটি টাকা ব্যয়ে কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানি ১০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন সরবরাহ করার পর নিম্নমানের ওই ইঞ্জিনগুলো গ্রহণ করতে রাজি হননি ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য লোকোমোটিভ, রিলিফ ক্রেন এবং লোকোমোটিভ সিমুলেটর সংগ্রহ’ প্রকল্পের পরিচালক নূর আহাম্মদ হোসেন। তিনি এসব ইঞ্জিন ক্রয় ও গ্রহণে রেলওয়ে মহাপরিচালক (ডিজি) মো. শামছুজ্জামান, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) আরএস মো. মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরীর বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ তুলেছেন।
সম্প্রতি রেলপথ সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটির (পিআইসি) ৬ কর্মকর্তা বরাবর অভিযোগসহ চিঠি দেন প্রকল্প পরিচালক। ১৭ ডিসেম্বর সেই অভিযোগপত্র গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট দপ্তর। একই সঙ্গে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের দাবি করা ৬৫ শতাংশ টাকা ছাড় না দেওয়ার জন্য সোনালী ব্যাংক লিমিটেড ও এডিবিকে চিঠি দিয়েছেন।

জানা গেছে, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ ১০টি লোকোমোটিভ ক্রয় করে সরকার। চুক্তি অনুযায়ী লোকোমোটিভগুলো সরবরাহ করা হলে ব্রডগেজ ও মিটারগেজ উভয় ধরনের ট্রেন পরিচালনা করা সম্ভব হতো (চাকার উপরে বডি স্থানান্তরের মাধ্যমে)। কিন্তু অভিযোগ পাওয়া গেছে, চুক্তি ভঙ্গ করে নিম্নমানের মালামাল দিয়ে ইঞ্জিনগুলো তৈরি করায় বেশি যাত্রী-মালামাল পরিবহন, উচ্চগতিতে ট্রেন চালানো, ভ্রমণে স্বাচ্ছন্দ্য ও দুর্ঘটনার হার কমানোর পরিকল্পনা অনেকটাই অসম্ভব।
অভিযোগ মিলেছে, চুক্তি অনুযায়ী ইঞ্জিনগুলোর হর্স পাওয়ার হওয়ার কথা তিন হাজার। কিন্তু দেওয়া হয়েছে দুই হাজার হর্স পাওয়ার। এছাড়া ইঞ্জিনগুলোয় টিএ-১২ মডেলের অলটারনেটর সংযোজনের কথা থাকলেও টিএ-৯ মডেলের অলটারনেটর সংযোজন করা হয়েছে— যা পুরনো মডেল ও কম ক্ষমতার। এতে ইঞ্জিনের গতি (হর্সপাওয়ার) ও ব্যাকআপ সিস্টেম কম ক্ষমতাসম্পন্ন হবে।
এর বাইরেও ইঞ্জিনগুলোয় আরও বড় ধরনের ত্রুটি রয়েছে বলে অভিযোগ মিলেছে। জানা গেছে, চুক্তিপত্রবহির্ভূত তিনটি ক্যাপিটাল কম্পোনেন্টের ভিন্নতা আছে। এর মধ্যে অলটারনেটর, ট্র্যাকশন মোটর সম্পূর্ণ ভিন্ন। চুক্তিপত্র অনুযায়ী ইঞ্জিনগুলো কমিশনের জন্য সব ধরনের মেশিনারিজ, পার্টস ও টুলস হুন্দাই রোটেমের সরবরাহ করার কথা। কিন্তু হুন্দাই রোটেম লোডবক্স টেস্ট প্ল্যান্ট সরবরাহ করেনি এবং ক্যাপিটাল কম্পোনেন্ট ভিন্নতর হওয়ায় পাহাড়তলী ওয়ার্কশপে সেই টেস্টটি করা হয়নি।
জানা গেছে, ইঞ্জিনগুলোর গুণগত মান খারাপ হলেও সেগুলো ফেরত না দিয়ে গ্রহণ করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ৭৩৩ কোটি ৬১ লাখ টাকার এ প্রকল্পে ইঞ্জিন ক্রয়ের চুক্তিমূল্য ছিল প্রায় ৩২৩ কোটি টাকা।
খোদ প্রকল্প পরিচালক নূর আহাম্মদ হোসেনই অভিযোগ এনেছেন, ইঞ্জিনগুলো জাহাজে তোলার আগে টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে বলে পিএসআই সার্টিফিকেট দেওয়ার কথা সংশ্লিষ্ট কোম্পানি সিসিআইসির। অথচ তারা কখনোই রেলওয়েকে অবহিত করেনি যে, চুক্তির স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী ইঞ্জিনগুলো তৈরি করা হচ্ছে না। বরং ইঞ্জিনগুলোতে নিম্নমানের ক্যাপিটাল কম্পোনেন্ট সংযোজন করার বিষয়টি তারা বরাবরই গোপন করে গেছে।

এমনকি গুণগত মান যাচাই করতে হুন্দাই রোটেমের কারখানা পরিদর্শনে যাওয়ার কথা ছিল রেলওয়ের একাধিক টিমের। কিন্তু কৌশলে বিষয়টি বারবার এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আর এই সুযোগে নিম্নমানের যন্ত্রাংশ দিয়ে ইঞ্জিনগুলো তৈরি করে হুন্দাই রোটেম।
জানা গেছে, ইঞ্জিনগুলোর প্রিশিপমেন্ট ইন্সপেকশন (পিএসআই) করার জন্য সিসিআইসির সঙ্গে চুক্তি করে রেলওয়ে। এ নিয়ে চলেছে আরেক নাটক। গত ১২ আগস্ট ইঞ্জিনগুলোর জন্য সিসিআইসি দুই ধরনের পিএসআই সার্টিফিকেট জমা দেয়। এর মধ্যে একটিতে ইঞ্জিনগুলো বাংলাদেশে পৌঁছার পর টেস্টিং, ট্রায়াল রান ও কমিশনিং সন্তোষজনক হবে বলে শর্তও দেওয়া হয়। কিন্তু পরে একই তারিখে এসব শর্ত বাদ দিয়ে আরেকটি পিএসআই সার্টিফিকেট দাখিল করে।
প্রকল্প পরিচালক নূর আহাম্মদ হোসেন জানান, ইঞ্জিন জাহাজীকরণের আগে প্রিশিপমেন্ট ইন্সপেক্টর পিএসআই সার্টিফিকেট ইস্যু না করায় এবং পরে একই তারিখে দুই ধরনের সার্টিফিকেট ইস্যু করায় ওই সার্টিফিকেটের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তার মনে সন্দেহ তৈরি হয়। এ কারণে মালামালগুলো জাহাজ থেকে না নামিয়ে আবার ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু রেলওয়ের ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জেনে প্রকল্প পরিচালককে ডেকে নিয়ে মালামালগুলো খালাস করার জন্য মৌখিক নির্দেশ দেন।
অভিযোগ রয়েছে, নিম্নমানের জেনেও রেলওয়ে মহাপরিচালক (ডিজি) মো. শামছুজ্জামান, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) আরএস মো. মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী সরাসরি হুন্দাই রোটেমের সরবরাহ করা ইঞ্জিনগুলোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন প্রকাশ্যে।
জানা গেছে, গত ১২ ডিসেম্বর পিআইসি (প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি) সভায় রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) মো. মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী জানান, যে ১০টি লোকোমোটিভ আনা হয়েছে সেগুলোর ট্রায়াল রান পারফরম্যান্স সন্তোষজনক। বাংলাদেশ রেলওয়ের ৩৯টি মিটারগেজ লোকোমোটিভ এ ক্ষমতার অলটারনেটর দিয়ে চলছে এবং আগামীতে আরও ২০টি লোকোমোটিভ এ অলটারনেটর দিয়ে আসবে।
অতিরিক্ত মহাপরিচালক এমন দাবি করলেও জানা গেছে, একই অলটারনেটর দিয়ে বিগত সময়ে যে ৩৯টি ইঞ্জিন কেনা হয়েছে সেগুলোর মান নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠেছে।

ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিন সরবরাহে অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে গত ২৪ নভেম্বর রেলওয়ের যুগ্ম সচিব ফয়জুর রহমান ফারুকীকে আহ্বায়ক করে দুই সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিস্ময়করভাবে সেখানে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) মো. মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরীকে। অথচ তার বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ এনেছেন খোদ প্রকল্প পরিচালক।

Related Posts